এই মুহূর্তে ভারতের অন্যতম বৃহৎ সংকটটির নাম: বাংলাদেশ। ঢাকার নির্বাচন-পরবর্তী ঘটনাক্রম দেখাইয়া দিতেছে যে নির্বাচনের কয়েক মাস আগে হইতে যে লাগাতার রাজনৈতিক সংঘর্ষে সে দেশ আচ্ছন্ন ছিল, সেই সংঘর্ষ পরিস্থিতি আরও অনেক তীব্র হইয়াছে, একটি ভোট-অনুষ্ঠান যেন রাতারাতি দেশটিকে দুই যুযুধান শিবিরে বিভক্ত করিয়া দিয়াছে। এক দিকে আওয়ামি লিগ-এর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ, অন্য দিকে বিরোধী দুই দল বি এন পি ও জামাত-এ-ইসলামি পক্ষ। মৌলবাদী, হিংসাপন্থী ইত্যাদি বিভাজনের অতি-সরলতায় যাইবার প্রয়োজন নাই, কেননা সকল সমাজগত ও ধর্মগত তকমা বাদ দিয়াই বলা যাইতে পারে, দুই রাজনৈতিক গোষ্ঠীর এই বিভাজনের মধ্যে জমা হইয়াছে তুমুল বিস্ফোরক বারুদ। এক দিকে যেমন সেই বারুদে জ্বলিতেছে বাংলাদেশের শহর-গ্রাম-জনপদ, প্রবল বিরোধিতার মধ্যেও ভোটদানের ‘স্পর্ধা’ দেখাইবার অপরাধে বহু মানুষের ঘরবাড়ি জমিজমা পুড়িতেছে, সঙ্গে সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তেও সেই বারুদ বিপুল বেগে আছড়াইয়া পড়িবার উপক্রম। যে কোনও দাঙ্গা-পরিস্থিতিতেই বাংলাদেশের প্রচুর নাগরিক উদ্ব্যস্ত হইয়া সীমান্ত পারাইয়া ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করেন, বর্তমান সংঘর্ষ পরিস্থিতিতে সেই সম্ভাবনা তো আরও বেশি, কেননা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চলাচল আপাতত অতি-দুরূহতায় পর্যবসিত। তদুপরি একটি পক্ষ সর্বদাই অপর পক্ষটিকে ভারত-তোষণের অপবাদে অভিযুক্ত করিয়া থাকে, সুতরাং এই সম্ভাবনাও যথেষ্ট যে হিংসাবশত কিছু আক্রমণকারীও এই সুযোগে ভারতে প্রবেশ করিতে চাহিবে। যেহেতু আন্তর্জাতিক জঙ্গি ইসলামের সহিত বাংলাদেশের জামাতের সম্পর্ক স্পষ্ট এবং যেহেতু আন্তর্জাতিক জঙ্গি ইসলামের ভারত-বিদ্বেষও সর্বজ্ঞাত, বিষয়টি ভারতের পক্ষে অতীব সংবেদনশীল। স্বভাবতই ভারতীয় উদ্বেগ সদ্যনির্বাচিত বাংলাদেশের সরকারের কাছে জানাইয়াছেন নয়াদিল্লির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। যুগ্ম সরকারি ব্যবস্থাপনায় এই সংকট সামলাইতে হইবে, ঢাকা ও দিল্লির উপলব্ধি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের করণীয় অবশ্য আরও খানিক বেশি। কেবল নিজের সীমান্ত সুরক্ষার চেষ্টা নহে, বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকার বিষয়েও নয়াদিল্লির একটি স্পষ্ট অবস্থানে আসা দরকার। মূল বিরোধী দলের বয়কটে এ বার বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত ভাবেই একপাক্ষিক হইয়াছে, মাত্র ২২ শতাংশ ভোট পড়িয়াছে, ক্ষমতাসীন সরকারই কার্যত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পুনরায় ক্ষমতার হাল ধরিয়াছে। স্বভাবতই গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে নূতন সরকারের বৈধতা প্রশ্নযোগ্য কিংবা সরাসরি অবৈধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন তাহাদের অনাস্থা ইতিমধ্যেই জানাইয়া দিয়াছে। গণতান্ত্রিক নীতিতে আমূল অঙ্গীকারবদ্ধ ভারতও স্বস্তিতে নাই।
তবে গণতন্ত্রের নীতি অনুযায়ী অন্য একটি প্রশ্নও এ ক্ষেত্রে উঠে বইকী। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে বিরোধী দলেরও কিছু ন্যূনতম দায়দায়িত্ব থাকিবার কথা। ক্রমাগত অনুরোধ-উপরোধ সত্ত্বেও রাজনৈতিক জেদ-বশত ভোট বয়কট করিয়া ভোটের প্রেক্ষিত রক্তাক্ত হিংসাদীর্ণ করিয়া তুলিবার অধিকারও গণতন্ত্রে গ্রহণযোগ্য নয়। ক্ষমতাপ্রাপ্ত সরকারের বৈধতার প্রশ্নটি যেমন জরুরি, সরকার প্রতিষ্ঠা তথা গণতন্ত্র-পদ্ধতির প্রতি স্পষ্টত অসহযোগ দেখাইবার জন্য বি এন পি-জামাতের গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নটিও সমধিক জরুরি। শেখ হাসিনারও যেমন সরকার-চালনার জন্য আরও ‘বৈধ’ জনভিত্তি দরকার, বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ারও উচিত, প্রয়োজনীয় শর্তসাপেক্ষে নির্বাচনের মতো গুরুতর গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ করা। বিশ্বের নিকট বাংলাদেশের সরকার-পক্ষ ও বিরোধী-পক্ষের এই পরস্পর-সংযুক্ত ‘দায়’-এর বিষয়টি তুলিয়া ধরিবার জন্য দরকার নয়াদিল্লিকে। দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষার লক্ষ্যে ভারত একটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করুক। |