ভর সন্ধ্যায় লক আপের মেঝেয় কম্বল পেতে শুয়েছিলেন বিচারাধীন বন্দিরা। আচমকাই এক বন্দি চিৎকার করে উঠলেন, ‘ওরে বাবা, মরে গেলাম রে’। শুরু হয়ে গেল হইচই। চিৎকার শুনে ছুটে গেলেন কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরা। সেই চেঁচামেচির মধ্যেই শোনা গেল আর এক জনের চিৎকার, ‘ওরে ব্বাস, এতো গোখরা মনে হচ্ছে!” ততক্ষণে এক বন্দির মুখ দিয়ে ফেনা উঠছে। পরে তাঁকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘ চিকিৎসার পরে সেই বন্দি সম্প্রতি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। হাসপাতাল সূত্রের খবর, তাঁর রক্তে বিপজ্জনক মাত্রায় ‘নিউরোটক্সিন’ মিলেছিল। সাধারণত, সাপে ছোবল দিলে যা রক্তে পাওয়া যায়।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের মাটিগাড়া থানার লক আপে এই ঘটনায় অসুস্থ হয়ে পড়া বন্দির নাম জাহাঙ্গির আলম। বাড়ি লাগোয়া এলাকাতেই। এক মহিলাকে নির্যাতনের মামলায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এখন তিনি সুস্থ হলেও তাঁর বাড়ির লোকজনদের অভিযোগ, জাহাঙ্গিরের প্রাণসংশয় হয়েছিল। সে জন্যই তাঁর পরিবারের তরফে নানা স্তরে অভিযোগ জানানো হয়। গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতিও (এপিডিআর) আসরে নামে। কিন্তু পুলিশ এখনও সরকারি ভাবে লক আপে সাপ ঢোকার বিষয়টি মানতে নারাজ। তাই পুলিশ নিজেদের গাফিলতি আড়াল করতে মরিয়া বলে অভিযোগ তুলেছে এপিডিআর। রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছেন তাঁরা। সম্প্রতি সমিতির শিলিগুড়ি শাখার তরফে পাঠানো অভিযোগপত্র পেয়ে তদন্তে নেমেছে মানবাধিকার কমিশন। তাতেই পুলিশ-প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে। এপিডিআর-এর শিলিগুড়ি শাখার মুখপাত্র বিবেক সরকার বলেন, “বন্দিদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়। সে কারণেই লক আপে সাপ ঢুকে একজনকে ছোবল দিয়েছিল। তিনি মারাও যেতে পারতেন। এই গাফিলতি আড়াল করা হবে কেন? সে কারণেই কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছি।”
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মাটিগাড়া থানার লকআপের মধ্যেই একটি ছোট শৌচাগার রয়েছে। সেখানে জল বেরোনোর জন্য একটা ছোট ফুটোও রয়েছে। শোচাগারের পিছনেই আগাছার জঙ্গল। সেখানে সাপ দেখেছেন থানার অনেকেই। তাই ওই ফুটো দিয়েই সাপ ঢুকেছে বলে সন্দেহ। ঘটনার পরে ওই ফুটোর মুখে জালও বসানো হয়েছে। যা আগেই দেওয়া উচিত ছিল বলে এপিডিআর-এর দাবি।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই লক আপে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা সে দিন ঠিক ভাবে কাজ করেনি কেন, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে এই সব প্রশ্নেই কমিশনের তদন্তে অস্বস্তিতে পড়তে পারেন বলে ভাবছেন শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের শীর্ষকর্তাদের অনেকেই। পুলিশ সূত্রের দাবি, ঘটনার দিন লক আপের দায়িত্বে যে পুলিশকর্মী ছিলেন, তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। তবে পুলিশেরই একাংশের দাবি, ওই পুলিশকর্মীকে সাসপেন্ড করে নিজেদের গা বাঁচাতে চাইছেন কর্তাদের একাংশ। অথচ পুলিশ সূত্রেই স্বীকার করা হয়েছে, ঘটনার তিন মাস পরেও লক আপের পিছনের ঝোপ পরিষ্কার করানো হয়নি।
যদিও শিলিগুড়ির পুলিশের ডিসি (সদর) ও জি পাল জানান, পুলিশের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলা হয়েছে। তিনি বলেন, “প্রতিটি থানার লক আপের নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করতে সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।” যে সময়ে ঘটনাটি ঘটেছে, তখন পুলিশ কমিশনার ছিলেন কারলিয়াপ্পন জয়রামন। মাস দুয়েক আগে তাঁকে অপসারণ করেছে রাজ্য সরকার। এ দিন প্রাক্তন পুলিশ কমিশনারকে ফোনে পাওয়া যায়নি। শিলিগুড়ির বর্তমান পুলিশ কমিশনার জগমোহন বলেন, “আমি বিশদে খোঁজখবর নেব। তার পরে যা বলার বলব।” |