রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ের তিনটি লেন টইটম্বুর তো বটেই। সমাবেশ যখন মাঝপথে, ধর্মতলায় ডোরিনা ক্রসিংয়ে যানচলাচল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ।
এই ছবি মঞ্চের সামনের। পিছনে শহিদ মিনার ময়দানের খাঁজে, কার্জন পার্কের ভিতরে, মেয়ো রোড ও ডাফরিন রোডের আনাচে-কানাচে ঢুকে ছিলেন মানুষ। এর সঙ্গে অভিনব কায়গায় নৌকো চেপে বাবুঘাট এবং প্রিন্সেপ ঘাটে এসে নেমেছেন সমর্থকেরা। বাস, গাড়ি ভাড়া এবং ট্রেনে শিয়ালদহ হয়ে আসার চেনা রুট তো আছেই।
সব মিলিয়ে ব্রিগেড সমাবেশের ঠিক এক মাস আগে কলকাতায় প্রায় মিনি ব্রিগেড করে ফেলল সিপিএম! উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সিপিএমের ‘ধর্মতলা অভিযান’কে ঘিরে বুধবার কয়েক ঘণ্টার জন্য অবরুদ্ধ হয়ে পড়ল মধ্য কলকাতা! লোকসভা ভোটের আগে যে জমায়েত দেখে উৎসাহিত সিপিএম ব্রিগেড ভরানোর জন্য আরও কোমর বেঁধে নামছে!
সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক গৌতম দেব ঠিক যত লোক আনবেন বলেছিলেন, কার্যক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে কি না সেই প্রশ্নে অবশ্যই বিতর্ক আছে। কিন্তু সিপিএম সূত্রের বক্তব্য, সংশয় এবং আশঙ্কা ছেড়ে নিজেরা তৎপর হয়ে আসরে নামলে এই প্রতিকূল আবহেও যে লোক জড়ো করা সম্ভব, এ দিনের সমাবেশ সেই স্পষ্ট বার্তাই দিয়ে গিয়েছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলকে। হুগলির চুঁচুড়া, বর্ধমান এবং কলকাতা ঘিরে উত্তর ২৪ পরগনা, এক মাসের মধ্যে তিনটি সমাবেশেই চোখে পড়ার মতো ভিড় স্বভাবতই মনোবল বাড়াল আলিমুদ্দিনের। |
বস্তুত, সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্ব মনে করছেন, ধীরে ধীরে তাঁদের সমর্থকদের মধ্যে ভয় ভাঙছে। তাঁরা আবার দলের কর্মসূচিতে বেরোতে শুরু করেছেন। তারই পরিণামে সংগঠিত কায়দায় লোক আনায় সাফল্য মিলছে। ধর্মতলার সমাবেশ সেরে সবাই নিরাপদে ফিরলেন কি না, তার খবর নিতে নিতেই এ দিন রাতে গৌতমবাবুর মন্তব্য, “ভয়-ভীতি ভাঙছে বলেই আমরা প্রত্যক্ষ সংগ্রামের কথা বলছি। তার মানে কাল থেকে মারামারি করতে যাওয়া নয়! পাড়ায় পাড়ায় হুজ্জতি করার লোকেরা যাতে মানুষের সমর্থন না পায়, সেটা আমাদের দেখতে হবে। যেতে হবে মানুষের কাছে। সেই কাজটা এর পরে আরও ভাল ভাবে করা যাবে।”
ধর্মতলার সভায় হাজির ছিলেন পাশের দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা সিপিএম সম্পাদক সুজন চক্রবর্তী। তিনিও গৌতমবাবুর কায়দায় জেলা জুড়ে লাগাতার সমাবেশের কর্মসূচি নিয়েছেন। সুজনবাবুর বক্তব্য, “সব দেখেশুনে মানুষ বুঝতে পারছেন, তাঁদের কিছু একটা করতে হবে। তাই আস্তে আস্তে তাঁরা সাড়া দিচ্ছেন।” পাশাপাশিই তাঁরা জানাচ্ছেন, ঘর ছেড়ে কর্মী-সমর্থকদের বেরোতে শুরু করার ‘ইতিবাচক’ প্রবণতা যাতে ভোটের বাক্সে সুফল দেয়, তার জন্য সাংগঠনিক পরিশ্রম করতে হবে।
গৌতমবাবুর সাফ কথা, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে আমরা সময় দেওয়ার কথা বলেছিলাম। ওঁর সরকার ৬০ মাসের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। তার মধ্যে অর্ধেকের বেশি (৩২ মাস) হয়ে গেল। এ বার আমাদের প্রত্যক্ষ সংগ্রামে যেতে হবে। এই সব সমাবেশ দলকে আরও তৈরি করবে।” আর এক ‘আক্রান্ত’ জেলা পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে সিপিএমের রাজ্য কমিটির এক সদস্যও বলছেন, “টানা ৩৪ বছর সরকারে থাকার পরে হঠাৎ বিরোধী দলে গিয়ে বাড়ি ভাঙচুর, জরিমানা, আক্রমণের মুখে সবাই গুটিয়ে গিয়েছিলেন। এখন আস্তে আস্তে তাঁরা বেরোচ্ছেন। তবে দলীয় নেতৃত্বের একাংশের মধ্যে এখনও দোদুল্যমানতা রয়েছে! তাঁরা যদি সংশয় কাটিয়ে আসরে নামতে পারেন, তা হলে আরও ভাল সাড়া মিলবে।” তবে একই সঙ্গে রাজ্য কমিটির এক সদস্যের সতর্ক মন্তব্য, “কেশপুর থেকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে সভা করলে চুপচাপ মানুষ ট্রেন ধরে চলে যাবে। কিন্তু কেশপুরে সভায় আসতে বললে এখনও মার খাওয়ার ভয় কাজ করবে! সেই পরিস্থিতির উন্নতি এখনও হয়নি।”
হুগলি এবং বর্ধমানের মতো কলকাতার সমাবেশেও মূল বক্তা ছিলেন দলের পলিটব্যুরো সদস্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা চেষ্টা করছে, বুদ্ধবাবুকে নিয়ে গিয়েই ব্রিগেডের আগে সেখানে সভা করতে। সুন্দরবন ঘেঁষা হিঙ্গলগঞ্জ থেকে শুরু করে কাঁচরাপাড়া পর্যন্ত নানা এলাকা থেকে যে ভাবে এ দিন লোক এসেছিল, তা দেখে বুদ্ধবাবু বলেছেন, “কাল রাত থাকতে বেরিয়েও অনেকে এসেছেন। এত বাধা অতিক্রম করে, এত পথ পেরিয়ে আপনারা এসেছেন। আপনাদের অভিনন্দন!” উজ্জীবিত গৌতমবাবু আবার ধর্মতলার মঞ্চেই ঘোষণা করে দিয়েছেন, ব্রিগেডে তাঁদের জেলা থেকে দেড় লক্ষ লোক নিয়ে যাবেন! যার অব্যবহিত পরেই বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান তথা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, “ব্রিগেডে একেবারে মাথা গুনতি করে ৭৫ হাজার থেকে এক লক্ষ লোক আনতে হবে। বাতাসে গুনে দেড় লক্ষ নয়!” |