রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদ ছাড়ার পরেও বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের পিছু ছাড়ছে না বিতর্ক। রাজ্য প্রশাসন এ বার প্রশ্ন তুলেছে, গত বছরের জুন মাসে পাকিস্তান সফরের সময় অশোকবাবু মানবাধিকার কমিশন থেকে পুরো বেতন নিয়েছিলেন কেন? এ ব্যাপারে কমিশন থেকে রিপোর্টও জোগাড় করেছে নবান্ন। প্রশাসন-সূত্রের খবর, পরবর্তী পদক্ষেপের আগে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অনিয়ম’ নিয়ে রাজ্য সরকার সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে একটি রিপোর্ট পাঠিয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, রাজ্য সরকার কিংবা রাজ্যপালের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অনুমতি না-নিয়েই তিনি পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। ইন্টার্নকে যৌন হেনস্থার অভিযোগের প্রেক্ষাপটে অশোকবাবুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতিকে পাঠানো কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার ফাইলে এই বিষয়টিও জুড়ে দেওয়া হয়। রাজ্য মানবাধিকার কমিশন থেকে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের পদত্যাগের পরে সেই ফাইলের আর তেমন গুরুত্ব না-থাকলেও তাঁর পাক সফর ঘিরে রাজ্য সরকারের তোলা অভিযোগের নিষ্পত্তি এখনও হয়নি।
‘পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অফ লেবার এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’ এবং ‘হামদর্দ ল স্কুল’-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক আলোচনাচক্রে যোগ দিতে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় ২০১২-র ৪-৫ জুন করাচি সফরে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে ৭ জুন মানবাধিকার কমিশনের অফিসে কাজে যোগ দেন। পাকিস্তানে তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন পাক বিচারপতি তথা ল স্কুলটির ডিন নাসির আলম জাহিদ। |
এবং বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের ওই বিদেশ সফরের বৈধতা নিয়েই পশ্চিমবঙ্গ সরকার আগে প্রশ্ন তুলেছে। এ বার তাঁর ওই সময়ের বেতনপ্রাপ্তি (রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে) নিয়েও অভিযোগের আঙুল উঠেছে রাজ্যের তরফে। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা বুধবার বলেন, “ওঁর পাকিস্তান সফর যেমন বেআইনি ছিল, তেমন সেই সময়ে কাজ না-করে বেতন নেওয়াও অনুচিত হয়েছে।” কর্তাটির যুক্তি, “উনি যদি রাজ্যপালের কাছে ছুটি নিয়ে পাকিস্তানে যেতেন, তা হলে ওঁর বেতন নিতে অসুবিধা ছিল না। কিন্তু সরকারি ভাবে দিন কয়েক ‘নিরুদ্দেশ’ থাকার পরেও তিনি পুরো মাসের বেতন নিয়ে থাকলে ঠিক কাজ করেননি।”
নবান্নের খবর, সংশ্লিষ্ট মাসের পুরো বেতন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় নিয়েছেন কি না, দিন কয়েক আগে কমিশনের কাছে তা জানতে চাওয়া হয়েছিল। কমিশনের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, সেই জুন মাসের পুরো মাইনেই অশোকবাবু নিয়েছেন। এখন পুরো বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীর গোচরে এনে পরবর্তী সিদ্ধান্ত হবে। এ ক্ষেত্রে অশোকবাবুর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে, প্রশাসনিক মহলে তা নিয়ে কথাবার্তাও শুরু হয়েছে। অনেকের ধারণা, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে বলা হতে পারে টাকা ফেরত দিতে। “পুরো ব্যাপারটা মুখ্যমন্ত্রীর নজরে আনা হচ্ছে। তিনি যেমন চাইবেন, তেমনই হবে।” মন্তব্য নবান্নের এক কর্তার।
যাঁকে ঘিরে এই নতুন বিতর্ক, তাঁর কী প্রতিক্রিয়া?
ইস্তফার পরেও এ সব বিষয় ফের সামনে আসায় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় যারপরনাই বিস্মিত। “ওই সময়ের বেতন নেওয়া যদি কারও অবৈধ বলে মনে হয়, তা হলে ওরা ফেরত নিয়ে নিতে পারে।” এ দিন মন্তব্য করেন তিনি। অশোকবাবু বলেন, “আমি পাকিস্তানে গিয়েছিলাম দু’দিনের জন্য। বিচারপতির চাকরিতে অবসরের পরে ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টও ছিল না। সাধারণ পাসপোর্ট করে ভিসা নিয়ে গরমের ছুটির মধ্যে ও দেশে যাই। ফেরার দিন তিনেক বাদে কাজে যোগ দিই।” রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের সদ্য প্রাক্তন চেয়ারম্যানের এখন প্রশ্ন, সরকার এত দিন পরে বিষয়টি উত্থাপন করল কেন? কেনই বা তিনি পাকিস্তান থেকে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে বেতন কেটে নেওয়া হল না?
এ হেন বিবিধ চাপান-উতোর, প্রশ্ন ও পাল্টা প্রশ্নের মাঝে ভবানী ভবনে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের অফিস বুধবার দিনভর খাঁ খাঁ করেছে। কমিশন-কর্মীরা মঙ্গলবার সকালেও ভেবেছিলেন চেয়ারম্যান অফিসে আসবেন। কারণ, তখনও তাঁর পদত্যাগ নিয়ে সংশয় ছিল। শেষমেশ অশোকবাবু দফতরে আর পা দেননি। এ দিন শুনানির জন্য চার জনের আসার কথা ছিল। এ দিকে চেয়ারম্যানের ইস্তফা নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় কোরামের অভাবে শুনানিও করা যাবে না। তাই তাঁদের দু’জনকে ফোনে আসতে বারণ করে দেওয়া হয়। যে দু’জন এসেছিলেন, তাঁদেরও পত্রপাঠ ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। চেয়ারম্যানের ঘর রয়েছে তালাবন্ধ।
অন্য দিকে খিদিরপুরে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে এ দিন সকাল থেকেই গমগমে পরিবেশ। সারা দেশের সংবাদ মাধ্যম তো বটেই, প্রচুর অত্যুৎসাহী মানুষেরও ভিড়। বিকেলে অশোকবাবুর সঙ্গে দেখা করেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র। ব্যঙ্গচিত্র-কাণ্ডে যাঁর মানবাধিকারের প্রশ্নে রাজ্য সরকারের কঠোর সমালোচনা করে ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করেছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ই।
আর তখন থেকেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্যের সূত্রপাত বলে এ দিন নিজেই দাবি করেছেন বিচারপতি অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায়।
|