পৌষ ডাকলেই সাইকেলে সওয়ার ওঁরা
প্যাডেলে চাপ পড়লেই বয়সটা যেন এক লাফে অনেকটা কমে যায়। পিছনে পড়ে থাকে বাড়ি, ঘর, রোজকার চেনা জীবন। সাইকেলের চাকা এগিয়ে চলে সামনের দিকে। এভাবেই জয়দেবের মেলা, পৌষ মেলা, গঙ্গাসাগর, মাসাঞ্জোরের পর এবার ওঁরা ঘুরে এলেন পুরী থেকে।
ওঁরা মধ্য পঞ্চাশের সাত ‘তরুণ’। একজনের বয়স সামান্য বেশি, ৬৭। পেশায় কেউ পুরোহিত, কেউ সাইকেল মিস্ত্রি, কেউ বাজারে মাছ বিক্রি করেন। ওঁরা কেউ চাঁদের পাহাড় যেতে চান না। চান কম খরচে, নিজেদের মতো করে একটু ঘুরতে। আর এমন সাধের ভ্রমণের জন্য তাঁরা বেছে নিয়েছেন নিজেদের চেনা বাহন সাইকেলকেই।
কিন্তু এই বয়সে এত পথ সাইকেলে? তেহট্টের ওই সাত তরুণ হাসতে হাসতে বলেন, “বয়স আবার কোনও বাধা নাকি কর্তা? ঘুরে বেড়ানোর এই তো বয়স। ছেলেমেয়েদের বিয়ে-থা হয়ে গিয়েছে। পৌষে হাতের কাজও একটু কম থাকে। বেরিয়ে পড়ার এই তো মোক্ষম সময়।”
২৫ ডিসেম্বর সাত সকালে আটপৌরে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন তেহট্টের সুনীল মণ্ডল, শিবেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, মন্টু বিশ্বাস, যাদবেন্দু আচার্য, জয়ন্ত বিশ্বাস, চিত্তরঞ্জন মুন্সি ও সুনীল হালদার। নাগাড়ে পনেরো দিন সাইকেল চালিয়ে পুরী ঘুরে বুধবার দুপুরে তাঁরা নবদ্বীপে আসেন। দুপুর দুটো নাগাদ রাণীরঘাটে একে একে থামল সাতটি সাইকেল। সামনের ঝুড়ির গায়ে নীল রঙের টিনের পাতে সাদা আর হলুদ রঙে ইংরাজিতে লেখা ‘টুরিস্ট, তেহট্ট থেকে পুরী’। সাইকেলের পিছনে একটা করে ক্যারিয়ার। সেখানে ঝোলানো রয়েছে গ্যাসের সিলিন্ডার, হাঁড়ি-কড়াই, সাইকেল মোরামতির যন্ত্রপাতি।
সফর সঙ্গী সাইকেল নিয়ে ওঁরা সাত জন। নবদ্বীপ ঘাটে তোলা নিজস্ব চিত্র।
ওঁরা বলেন, “সম্বৎসর যে যার মতো খেটে খাই। কিন্তু পৌষ মাসটা এলেই বেরিয়ে পড়ার ভূতটা যেন মাথায় চেপে বসে।” তবে ওঁদের এই সাইকেল-যাত্রা এই প্রথম নয়। এর আগে তাঁরা নয় বার বেরিয়েছেন। তেহট্টের রাধানগরের সুনীলবাবু বলেন, “১৯৮৭ সাল থেকে আমাদের যাত্রা শুরু। সে বার গিয়েছিলাম কল্যাণীর ঘোষপাড়ার সতী মায়ের মেলা দেখতে। তখনই বুঝেছিলাম, এত কম খরচে, স্বাধীনভাবে বেড়ানোর জন্য সাইকেলই আমাদের জন্য সবথেকে ভাল বাহন। তারপর অনেকে আমাদের সঙ্গে দলে ভিড়েছেন। চলেও গিয়েছেন। আবার এসেছে নতুন মুখ। কিন্তু থেমে থাকেনি সাইকেলের চাকা।”
দলের সবথেকে প্রবীণ সদস্য মন্টু বিশ্বাস বলেন, “ঘুরে আসার পর জীবনের প্রতি ভালোবাসা, কাজের উৎসাহ সবই যেন আরও বেড়ে যায়। বাড়ির সকলেও আমাদের এই বেরিয়ে পড়াতে উৎসাহ দেন।” চিত্তবাবু বলেন, “জলঙ্গি নদীর উৎস মুখ খুঁজতে গিয়ে একবারই আমরা খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। বহু খুঁজেও আমরা অনেক কিছু দেখতে পেলেও উৎস মুখ খুঁজে পাইনি।”
আশ্চর্য ওঁদের খোঁজা! এবার কটক পৌঁছে ৩০ ডিসেম্বর দিনভর খুঁজে বের করেছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বাড়ি। পুরীর মন্দিরের থেকেও ওঁদের বেশি টেনেছে রাতের কোণারক বা সকালের ধওলগিরি। মাত্র ১২০০ টাকা করে মাথাপিছু দিয়ে তৈরি করেছিলেন ‘কমন ফান্ড’। এছাড়া প্রত্যেকে নিজেদের সামর্থ্য মতো নগদ টাকা সঙ্গে নিয়েছিলেন। তবে সেই টাকা সবথেকে বেশি ছিল সুনীলবাবুর কাছে। কত টাকা নিয়েছিলেন? ছোট্ট পকেট ডায়েরি দেখে লাজুক হেসে সুনীলবাবু বলেন, “২৭৯০ টাকা। সবটা অবশ্য খরচ হয়নি। এখনও কিছু পড়ে রয়েছে।”
২৫ ডিসেম্বর তাঁদের যাত্রা শুরু হয়েছিল তেহট্ট জিৎপুর মোড় থেকে। তারপর প্রতিদিন সাইকেল চালিয়েছেন ওঁরা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই বিরতি। আশ্রয় মিলেছে স্কুলবাড়ি, মন্দিরের অতিথিশালা কিংবা চালকলের গোডাউনে। সেখানেই ডালেভাতে ফুটিয়ে নেওয়া।
এ বার বাড়ি ফেরা। বিকেল ফুরিয়ে আসছে। রাতারাতি যদি তেহট্ট পৌঁছনো যায়। প্যাডেলে চাপ দিয়েই মন্টুবাবু হাওয়ায় ভাসিয়ে দেন, “দেখবেন, সামনের বার বেঁচে থাকলে আরও দূরে যাব...আরও দূরে।” সাত ‘যুবকের’ সাইকেল প্রথম সাঁঝে হারিয়ে যায়।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.