ঘাটে ভিড়তে তখনও কিছুটা বাকি। কিন্তু সোমবার মায়াপুর ছেড়ে নবদ্বীপের দিকে পৌঁছনোর মুখেই ঘটল বিপত্তি। নৌকার একদিক থেকে হঠাৎ আর্ত চিৎকার, “পড়ে গেল, পড়ে গেল।” ততক্ষণে জলের তোড়ে বেশ কিছুটা ভেসে গিয়েছেন নৌকার এক মহিলা যাত্রী। ওই মহিলার সঙ্গীরা কান্নাকাটি করছেন। অন্য যাত্রীরা দিশেহারা। এরপর আর দেরি করেননি নবদ্বীপের প্রবীণ মাঝি নিরঞ্জন হালদার। সঙ্গী মাঝিকে কিছু একটা নির্দেশ দিয়ে সোজা ঝলে ঝাঁপ। পরের কয়েকটা মুহূর্ত দমবন্ধ করা সিনেমার মতো। স্রোতের টানে ভেসে চলেছেন এক মহিলা। আর বেশ কয়েক হাত পিছনে সাঁতরে তাঁকে ধরতে চাইছেন আর একজন মাঝি। ইতিমধ্যে ঘাটে ভিড়েছে নৌকাটি। ভেসে যাওয়া মেয়েটির দাদা এবং আরও দু’জন গঙ্গার এবড়ো খেবড়ো পাথুরে পাড় ধরে ছুটতে ছুটতে চিৎকার করছেন, “ওকে বাঁচান, ও ডুবে গেল...”
ঘাট থেকে দ্রুত যাত্রী নামিয়ে ভেসে যাওয়া মহিলার দিকে ছুটে গিয়েছে সেই নৌকাটিও। অন্য মাঝি সুমন সরকার ছুড়ে দিয়েছেন লাইফ বেল্ট। কিন্তু ধরবে কে? পৌষের সকালে হিমঠান্ডা জলে ওই মহিলার আর নড়ার শক্তিটুকুও যেন ছিল না। বেশ কিছুক্ষণের লড়াইয়ের পর অভিজ্ঞ মাঝি নিরঞ্জনবাবু ওই মহিলাকে উদ্ধার করেন। ভাসতে ভাসতে স্রোতের টানে তাঁরা তখন পৌঁছে গিয়েছেন শ্রীবাসঅঙ্গন ঘাটে। এরপর ওই মহিলাকে নিয়ে সোজা নবদ্বীপ স্টেট জেনারেল হাসপাতাল। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাঁকে বিপন্মুক্ত বলে জানান চিকিৎসকেরা। |
রবিবার উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ার উচিলদহ গড় গ্রামের বাসিন্দা শান্তুকুমার দাস নিজের আত্মীয়, বন্ধুদের জনা পনেরোর দল নিয়ে মায়াপুর-নবদ্বীপ ঘুরতে এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন বোন দীপা নায়েক ও তার স্বামী সঞ্জয় নায়েক। শান্তুবাবু বলেন, “বোনের বিয়ে হয়েছে বছর খানেক আগে। সবাই মিলে বেড়াতে এসে এই বিপদ। বোন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।” তিনি বলেন, “সকালে মায়াপুর থেকে নবদ্বীপে আসার সময় বোন ঝুঁকে পড়ে নৌকা থেকে গঙ্গা-জলঙ্গির দুটো জল কীভাবে মিশেছে সেটাই দেখছিল। তখনই মাথা ঘুরে সে জলে পড়ে যায়। ওই মাঝি না থাকলে যে কী হত ভাবতে পারছি না।”
নবদ্বীপ হাসপাতাল বোনকে বিপন্মুক্ত বললেও ভরসা রাখতে পারেননি শান্তুবাব। নবদ্বীপ থেকে সোজা অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যান আর জি কর হাসপাতালে। সেখানেও চিকিৎসকেরা মা এবং গর্ভস্থ শিশুকে বিপন্মুক্ত বলে জানান।” দীপাদেবী বলেন, “হঠাৎ মাথাটা যেন কেমন ঘুরে গিয়েছিল। তারপর আর কিছু মনে নেই। ওই মাঝি না থাকলে যে কী হত ভাবলেই শিউরে উঠছি।”
শান্তুবাবু বলছেন, “আমরা আবার নবদ্বীপ যাবো শুধু ওই মাঝির জন্য। ওঁকে আমাদের পরিবারের তরফ থেকে প্রণাম। উনি যেন এভাবেই সারাজীবন মানুষের বিপদে পাশে থাকেন।”
আর যাঁকে নিয়ে এত কিছু, ৫৮ বছরের সেই নিরঞ্জন হালদার অবশ্য নির্বিকার। নৌকা বাইতে বাইতে তিনি বলেন, “৩৫ বছর ধরে নিরাপদে লোকজনকে পাড় করছি। এদিনও সেটাই করেছি। এটা নিয়ে এত মাতামাতি করার কী আছে!” |