মাদক দেওয়া সন্দেশ খাইয়েই আচ্ছন্ন করে দেওয়া হয়েছিল দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী আত্রেয়ী বসু সহ তাঁর পরিবারের তিন জনকে। তারপরে তাঁদের শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়। সোমবার বিকেলে আত্রেয়ী, তাঁর মা মধ্য চল্লিশের বিজয়া বসু ও মায়ের পিসি বৃদ্ধা প্রভা দাসের দেহ উদ্ধার হয় বহরমপুরের একটি ফ্ল্যাট থেকে। পুলিশের ধারণা, এই পরিবারের খুবই পরিচিত কেউ শনিবার সন্ধ্যায় তাঁদের বাড়ি এসেছিলেন। তিনিই সঙ্গে করে সেই সন্দেশ এনেছিলেন। তবে এখনও পর্যন্ত সেই ঘটনায় পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি বলে খুনের কিনারার দাবিতে পথে নামলেন বহরমপুরের মহিলারা। বুধবার সন্ধ্যায় তাঁরা শহরে মোমবাতি মিছিল করেন।
পুলিশের অবশ্য দাবি, দ্রুতই ঘটনার কিনারা করা যাবে। বহরমপুর থানার আইসি মোহায়মেনুল হক বলেন, “ওই বাড়ি থেকে সন্দেশ ও রসগোল্লা পাওয়া গিয়েছে। রসগোল্লা ছিল চারটি। তার মধ্যে একটি আধ খাওয়া। তবে রসগোল্লাগুলি বিজয়াদেবীই কিনেছিলেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। কোথা থেকে কিনেছেন, তা-ও জানা গিয়েছে। কিন্তু সন্দেশ কোথা থেকে এল, তা জানা যাচ্ছে না। সন্দেশের প্যাকটেটিতে ছ’টি সন্দেশ পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু আরও চারটি রাখার জায়গা ছিল। সন্দেশগুলি ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।” পুলিশের অনুমান, আত্রেয়ীদের তিন জনকে ওই সন্দেশ খাওয়ানো হয়েছিল। আর একটি সন্দেশ সম্ভবত যিনি এনেছিলেন, তিনিই খেয়েছেন। কিন্তু প্যাকেটে সম্ভবত কেবল বাছাই করা তিনটি সন্দেশেই মাদক মেশানো ছিল। সেই সন্দেশ খেয়েই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন আত্রেয়ীরা। তারপরে তাঁর মাথায় ও বিজয়াদেবী এবং প্রভাদেবীর বুকে আঘাত করা হয়। এরপরে তিন জনের শ্বাসরোধও করা হয়। ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে রসগোল্লাগুলিও। আইসি মোহায়মেনুল হক বলেন, “ওই সন্দেশ কোথা থেকে কেনা হয়েছিল, তা আমরা খোঁজ করে দেখছি। কিন্তু সাদা পিচবোর্ডের প্যাকেটটির গায়ে কোনও মিষ্টির দোকানের নাম লেখা নেই।” তাতেই পুলিশের সন্দেহ আরও দৃঢ় হচ্ছে। ওই বাড়িতে যিনি রান্নার কাজ করেন, তাঁকেও জেরা করছে পুলিশ। ঘটনার দিন সন্ধ্যাতেও তিনি ওই বাড়িতে গিয়েছিলেন। জেরা করা হচ্ছে আরও বেশ কয়েকজনকে। |
তবে আত্রেয়ীদের খুনে অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবিতে বুধবার সন্ধ্যায় বহরমপুরের মহিলারা শহরে মোমবাতি মিছিল করেন। মিছিলে ছিলেন আত্রেয়ীয়ের সহপাঠী, শিক্ষিকা এবং প্রতিবেশীরাও। তাঁদের বক্তব্য, খুনের পরে যে ভাবে তরুণী আত্রেয়ী এবং তাঁর মায়ের দেহ ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছিল, তা সভ্য সমাজের লজ্জা। আত্রেয়ীদের প্রতিবেশী সংঘমিত্রা রায় বলেন, “খুনের পরে একটি তরুণী মেয়ে ও তাঁর মা’কে যে ভাবে নগ্ন ও অর্ধনগ্ন করে ফেলে রেখে যাওয়া হয়, তাতে বীভৎস একটা বিকৃতি প্রকাশ পেয়েছে। এটা আমরা মেনে নিতে পারিনি। তাই আমরা চাই ওই ঘটনায় অপরাধীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক।” আত্রেয়ীয়ের বন্ধু দিশা বিশ্বাসের কথায়, “সেই কারণেই পুলিশ-প্রশাসনের উপরে চাপ বাড়াতে এই মিছিলের আয়োজন করা হয়।”
মোমবাতি মিছিলের ভাবনা প্রথম মাথায় এসেছিল সংঘমিত্রাদেবী ও তাঁর প্রতিবেশী চন্দ্রাণী হাজরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। চন্দ্রাণীদেবী বলেন, “ওই তিন জনের মৃত্যুতে শুধু শোক নয়, রাগও হয়েছে আমাদের সকলের। পুলিশও এখনও পর্যন্ত কাউকে ধরতে পারেনি। তাই মোমবাতি মিছিলের আয়োজন করি আমরা।” তিনি
জানান, মিছিলের কথা ফেসবুকের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। আত্রেয়ীয়ের বন্ধুরা সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেন। স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে সাড়া দেন বহু মহিলাও। টেলিফোনও করা হয়েছিল অনেককে। সব মিলিয়ে প্রায় আটশো মহিলা জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে এ দিন সন্ধ্যায় আত্রেয়ীদের ফ্ল্যাট থেকে শুরু করে রানিবাগান, লালদিঘি হয়ে
পুলিশ সুপার ও জেলাশাসকের বাংলো ছুঁয়ে বহরমপুর থানার পাশ দিয়ে গির্জার মোড় পার করে ওই আবাসনে ফিরে আসে।
চলতি বছরের ৭ জুন কামদুনিতে এক কলেজ ছাত্রীকে গণধর্ষণ করে খুন করে দুষ্কৃতীরা। তার প্রতিবাদে রাজ্য জুড়ে নানা জায়গায় মোমবাতি মিছিল হয়। শুধু তাই নয়, খরজুনা, গাইঘাটা এবং সম্প্রতি মধ্যমগ্রামে গণধর্ষণ ও ছাত্রী খুনের ঘটনার পরে বিভিন্ন এলাকায় মোমবাতি মিছিল করে নীরব প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
আত্রেয়ীদের আর এক প্রতিবেশী রত্না দাস বলেন, “বারাসত, কামদুনি, খরজুনা কাণ্ডেও বহরমপুরের মানুষ মোমবাতি মিছিল করে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। গত বছর ডিসেম্বরে দিল্লিতে ধর্ষিতা এক ছাত্রীর মৃত্যুর পরে মোমবাতি মিছিল করা হয়েছিল বহরমপুরে। কিন্তু শহরের বুকেই এমন ঘটনার জন্য মোমবাতি মিছিল করতে হবে, তা স্বপ্নেও ভাবিনি।” এ দিনের মিছিল ছিল অরাজনৈতিক।
অতিরিক্ত জেলাশাসক সন্দীপ দত্ত বলেন, “ওই তিন জনকে খুন একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তবে ঘটনায় নিশ্চয়ই এলাকার মানুষের আবেগে ধাক্কা লেগেছে। তাই তাঁরা প্রতিবাদ মিছিল করেছেন। পুলিশ-প্রশাসন অবশ্য
খুব গুরুত্ব দিয়েই ওই খুনের ঘটনার তদন্ত করছে।”
|