এক দল নীতিই সাফল্যের রসায়ন

ইস্টবেঙ্গল: ২ (মোগা, চিডি)
কালীঘাট এমএস: ০
মুদ্রের ঢেউয়ের মধ্যে দুলতে থাকা ডিঙি নৌকাকে যেমন দেখায়, প্রেসবক্স থেকে তেমনই দেখাচ্ছিল আর্মান্দো কোলাসোকে!
লাল-হলুদ সমর্থক-সমুদ্রের মধ্যে তাঁর হাত তোলা হাসিমুখটা একবার দেখা যাচ্ছিল, পরমুহূর্তে ডুবে যাচ্ছিল। যেমন দেখা যায় গোয়ান কোচের বাড়ি আগেসাইনের অদূরে, আরব সাগরে। প্রতিদিন। ডিঙি নৌকোগুলোকে।
ম্যাচ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাধভাঙা উচ্ছ্বাসে ফেন্সিং টপকে ঢুকে পড়েছিলেন কয়েক হাজার সমথর্ক। তাঁরাই হাতে হাতে মাথার উপর তুলে নিয়ে দোলাচ্ছিলেন আর্মান্দোকে। ঢেউয়ের মতো করে। বুকে পেস মেকার। তা সত্ত্বেও এই উচ্ছ্বাসটা উপভোগ করছিলেন দেশের সফলতম কোচ। তাঁর মুখের উপর উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে আবির। শ্যাম্পেনের মতো ছেটানো হচ্ছিল বোতলের জল। তা সত্ত্বেও তিনি হাসছেন। নির্মল হাসি। মনে হল এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন যেন।

ডিফেন্স ভাঙছেন মোগা।
“গোয়ার ক্লাবের হয়ে বহু ট্রফি জিতেছি। কিন্তু এ রকম আবেগ দেখিনি। এত দিন গোয়ায় বসে কাগজে বা টিভিতে এই দৃশ্য দেখতাম। আজ তো আমাকে নিয়েই......। সব কৃতিত্ব ছেলেদের। আমার স্বপ্ন সফল। ড্রেসিংরুমে ঢুকে মেয়েকে ফোন করেছিলাম, সে কী রকম উত্তেজিত জানেন...” বুজে আসে গলা। তাঁকে দেখে কে বলবে রেকর্ড সংখ্যক পাঁচ বারের আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন! কে বলবে এই লোকটা ফেড কাপ-সহ অসংখ্য ট্রফি জিতেছেন তুড়ি মেরে! কথা বলার সময় মনে হচ্ছিল ডেম্পো ছাড়ার পর তাঁকে ঘিরে যে অযথা আর্থিক-বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, সেটা এতদিন বিষ-বাষ্প হয়ে জমা ছিল। বুধবার সেটার প্রাথমিক বিস্ফোরণ ঘটেছে। ক্লাব কর্তারা পুলিশ এনে তাঁকে উদ্ধার না করলে কী হত কে জানে?
টাটকা ইলিশ দেখা না গেলেও, থার্মাকোলের ইলিশ গলায় ঝুলিয়ে এসেছিলেন জনা দুই সমর্থক। লাল-হলুদ রং মুখে মেখে এসেছিলেন বাবার সঙ্গে মেয়ে। মায়ের সঙ্গে ছোট ছেলে। এক ফুট থেকে একশো ফুট—অসংখ্য পতাকা মাঠ জুড়ে। সাতের দশকের স্মৃতি উসকে দিয়ে তালতলা ক্লাব পর্যন্ত টিকিটের লম্বা লাইন। আবির, ব্যান্ড। দু’অর্ধে মোগা-চিডির দু’টো গোলের পর হাজার সতেরো দর্শকের শব্দব্রহ্ম আছড়ে পড়ল। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোথায় যেন এই উচ্ছ্বাস মেলানো যাচ্ছিল না, ট্রেভর মর্গ্যানের জমানার গতবারের লিগ জয়ের হ্যাটট্রিক পরবর্তী বোহেমিয়ান আবেগকে। অধিনায়ক মেহতাব হোসেন বলছিলেন, “ভুলে যাবেন না গতবার শেষ ম্যাচ ছিল ডার্বি। ডার্বি জিতেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম আমরা। এ বার তো ডার্বি বাকি। ওটা না জিতলে তো কলকাতা লিগ জয়ের মজাটাই পুরো পান না সমর্থকরা।”

ভালবাসার অত্যাচার। শিকার চিডি। বুধবার ইস্টবেঙ্গল মাঠে।
কর্তারা অবশ্য ডার্বির জন্য অপেক্ষা করেননি। ম্যাচের পরই কোচ-ফুটবলারদের লনে ডেকে এনে প্রথা মেনে পতাকা তুলে দিয়েছেন। হয়তো নিজেদের মাঠে বহুদিন পর চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচ জেতার আবহই তাঁদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। প্রেসিডেন্ট প্রণব দাশগুপ্ত বলছিলেন, “গতকালই আমাকে ক্লাব থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল ম্যাচের পর পতাকা তুলতে হবে। তাই ম্যাচ শুরুর কিছুক্ষণ পর চলে এসেছিলাম।” প্রস্তুত না থাকার কোনও কারণও ছিল না লাল-হলুদ শিবিরের। দুর্বল কালীঘাট এমএসের বিরুদ্ধে ড্র করলেই যেখানে চ্যাম্পিয়ন হওয়া যাবে সেখানে তো উৎসবের প্রস্তুতি রাখতেই হবে। ম্যাচটা মোগা-চিডি-সুবোধ-কেভিনরা জিতলেন কোনও প্রতিরোধ ছাড়াই।
প্রথমার্ধে মোগার গোলটা মনে হল অফসাইড। সুবোধকুমার বলটা ছাড়ার পর মোগা দাঁড়িয়েও পড়েছিলেন। কিন্তু আজ তো উৎসবের দিন। সহকারি রেফারি বরুণ সাহাও তাতে যোগ দিয়েছিলেন হয়তো। তবে মোগার বদলি হিসাবে চিডি নামার পর সেই বিতর্ক থেমে গেল। নামার এক মিনিটের মধ্যেই প্রথম টাচে গোল করলেন নাইজিরিয়ান গোলমেশিন। ডার্বি এবং ফেড কাপের আগে যা শুভ সঙ্কেত। অশনি সঙ্কেত যে ছিল না তা নয়। সুয়োকা পেনাল্টি নষ্ট করলেন। মোগা হ্যাটট্রিক করতে পারতেন। পারলেন না প্রচুর সহজ সুযোগ নষ্ট করায়। ইস্টবেঙ্গল মাঝমাঠকেও কেমন যেন অগোছালো দেখাল।

কোলাসো। সব মাথা ছাড়িয়ে।
এ বার নিয়ে ৩৫ বার কলকাতা লিগ জিতল ইস্টবেঙ্গল। বাগানের থেকে ছয় বার বেশি। সমরেশ-সুধীরদের ছয় বারের লিগ জয়ের অক্ষত রেকর্ড। ষোলো বার অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার হাতছানি। এ রকম সব আকর্ষণীয় পরিসংখ্যান থাকা সত্ত্বেও টানা চার বার লিগ জয়ের ধারাবাহিকতাকে খাটো করে দেখা যাচ্ছে না। বরং উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। কারণ পাশের ১২৫ বছর ছুঁয়ে ফেলা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর তাঁবুতে সাড়ে তিন বছর যে কোনও ট্রফিই নেই। বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা গেল, বিশাল তাঁবুটা খাঁ খাঁ করছে। জনা সাতেক লোক চেয়ারে বসে। বাগানের পক্ষ থেকে অবশ্য শুভেচ্ছা জানিয়ে সন্ধ্যায় মিষ্টি ও ফুল পাঠানো হয়েছে লাল-হলুদ তাঁবুতে। সৌজন্য দেখাতে।
কিন্তু বাগানকে অন্ধকারে পাঠিয়ে বাংলা ফুটবলে মশালের এই দাপাদাপির পিছনে রসায়নটা কী? চৌম্বকে উঠে আসছে একটাই কারণ—একই টিম দীর্ঘদিন ধরে রাখার নীতি। ডেম্পোতে যে নীতি অনুসরণ করে বিশাল সাফল্য পেয়েছিলেন বর্তমান ইস্টবেঙ্গল কোচ।
১৯৭০-৭৫ টানা ছয় বার লিগ জিতেছিল লাল-হলুদ। এর মধ্যে শেষ চার বার যাঁর কোচিংয়ে লিগ জেতা, সেই প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ও মানছেন সে কথা। তবে তিনি এর সঙ্গে যুক্ত করতে চান প্রাক্তন কোচ ট্রেভর মর্গ্যানকেও। বলছিলেন, “ক্লাব কর্তাদের টিম নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত ও মর্গ্যানের জন্যই এই সাফল্য। আমার সময়ের মতোই একই টিম রেখে দিয়েছেন কর্তারা। মূল টিমটা ধরে রাখলে কাজটা সহজ হয় কোচের। আর মর্গ্যান সেটা তিন বছর ধরে চাষ করে সোনার ফসলটা দিয়ে গিয়েছেন।

বুধবার লিগ জয়ের আনন্দে মাতোয়ারা লাল-হলুদ সমর্থকরা।
কোলাসো তা নিয়ে সাফল্য পেয়েছেন এ বার।”পাশাপাশি ইস্টবেঙ্গলের স্বর্ণযুগের কোচের মন্তব্য, “টিমে শুনলাম একজন মাত্র বঙ্গসন্তান ছিল। বিদেশিদের দাপট বাড়ছে দেখলে খারাপ লাগে। সমরেশ-সুধীররা কোথায় গেল? ওরাই তো আমার লিগ জয়ের টেক্কা ছিল।” পি কে এ কথা বললেও, আর্মান্দো কৃতিত্ব পাবেন অন্য কারণে। মার্কোস ফালোপার হাত থেকে মাঝপথে টিম নিয়ে সাফল্য পেয়েছেন বলে। চিডির মতো ফুটবলার সে জন্যই এ বারের লিগ জয়কে বলছেন ‘স্পেশ্যাল’।
ইস্টবেঙ্গল শিবির অবশ্য কলকাতা লিগ জয়ের পরও ‘স্পেশ্যাল’ ম্যাচের জন্য অপেক্ষা করছে—শনিবারের ডার্বি। আর কে না জানে, মোহনবাগানকে হারাতে না পারলে লাল-হলুদ সমর্থকদের কাছে সব জয়ই হয়ে যায় ট্র্যাজিক!
“শুধু কলকাতা লিগ নয়, ইস্টবেঙ্গলের এই টিমটার আই লিগ, ফেড কাপের মতো জাতীয় স্তরের সব টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন হওয়া উচিত। খুব শক্তিশালী দল। ভাল ফুটবলার রয়েছে দলে। আশা করব, পরের টুর্নামেন্টগুলোতেও একই ভাবে সাফল্য পাবে ইস্টবেঙ্গল। কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য ইস্টবেঙ্গল কোচ, ফুটবলার এবং সদস্য-সমর্থকদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই।” —

“ইস্টবেঙ্গল কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে শুনে আমি খুব খুশি। আরও ভাল লাগছে এই লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পিছনে আমারও কিছু অবদান রয়েছে। লিগের শুরুতে আমার কোচিংয়েও তো বেশ কিছু ম্যাচ বড় ব্যবধানে জিতেছিল ইস্টবেঙ্গল। কোলাসো এবং ফুটবলারদের জন্য শুভেচ্ছা রইল।”

(ইস্টবেঙ্গল কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর আনন্দবাজারে দুই প্রাক্তন লাল-হলুদ কোচ)

ইস্টবেঙ্গল:
গুরপ্রীত, নওবা, রাজু, অর্ণব, রবার্ট, সুবোধ, ডিকা (তুলুঙ্গা), জোয়াকিম (লেন), কেভিন, মোগা (চিডি), সুয়োকা।

ছবি: উৎপল সরকার।

পুরনো খবর:




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.