প্রবন্ধ ২...
সৎ আমলাদের সুরক্ষা দেওয়া জরুরি
৯৮৮ সালে পাশ হয়েছিল দুর্নীতি নিবারণ আইন। এটি সরকারি কর্মীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কোনও সরকারি কর্মী অন্যায় ভাবে নিজের পদ ব্যবহার করে আর্থিক বা অন্য সুবিধে আদায় করলে অথবা আর্থিক সম্পদ আত্মসাৎ করলে এই আইনে অপরাধী সাব্যস্ত হন। যদি কোনও সরকারি কর্মী এমন কোনও মূল্যবান জিনিস বা আর্থিক সুযোগ পান, যা কোনও ‘জনস্বার্থ’ সিদ্ধ করে না, তা হলে এই আইনের ১৩ (১) (ঘ) (৩) ধারা প্রযোজ্য হতে পারে। আমলারা সরকারি কর্মী, তাঁদের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত অন্যদের উপর প্রভাব ফেলে। এই সব সিদ্ধান্তের সমস্ত পরিণাম আগে থেকে পুরোপুরি অনুমান করা অসম্ভব। ‘জনস্বার্থ’ ব্যাপারটাও খুব অস্পষ্ট, অনির্দিষ্ট ফলে এই আইন নানা সমস্যাও তৈরি করে।
দুর্নীতি নিবারণ আইনের উপরোক্ত ধারাটির ভয়ে সরকারি কর্মীরা অনেক সময়েই অতি সতর্ক হয়ে পড়েন। কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্তে প্রধান ভূমিকা নেয় কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশন (সি ভি সি)। ১৯৬৪ সালে সি ভি সি’র জন্ম, তবে এটিকে ‘স্ট্যাটিউটরি’ বা বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে ২০০৩ সালে। গত কয়েক বছরে সি ভি সি’র কাছে ক’টি অভিযোগ জমা পড়েছে, তার হিসেব তাৎপর্যপূর্ণ। ২০০৮ সালে সি ভি সি’র কাছে ১০,১৪২টি অভিযোগ জমা পড়েছিল, পরের বছর সেটা বেড়ে হয় ১৪,২০৬। ২০০৯ ও ২০১০’এর সংখ্যা দুটি যথাক্রমে ১৬,২৬০ এবং ১৬,৯২৯। ২০১২ সালে অভিযোগের সংখ্যা প্রচুর বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৩৭,০৩৯। মনে রাখা দরকার, এই অভিযোগ সরকারের ভিতর থেকে আসতে পারে, বাইরে থেকেও কেউ অভিযোগ করতে পারে। সরকারের ভিতর থেকে আসা অভিযোগের সংখ্যা বিশেষ বাড়েনি, মোটামুটি হাজার পাঁচেকের আশেপাশেই আছে।
২০০৩-এ দুর্নীতিচক্রের বলি সত্যেন্দ্র দুবে।
তালিকায় যে সংখ্যাবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, সেটা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির একটা সংকেত দেয়। তা ছাড়া, সরকারি কাঠামোর মধ্যে থেকে যাঁরা দুর্নীতির খবর ফাঁস করে দেন, সেই ‘হুইসলব্লোয়ার’দেরও একটা ভূমিকা এখানে থাকতে পারে। হুইসলব্লোয়ারদের রক্ষাকবচ দেওয়ার জন্য প্রস্তাবিত বিলটি ২০১১ সালে লোকসভায় পাশ হলেও সেটি এখনও রাজ্যসভায় পড়ে আছে। প্রসঙ্গত, উপভোক্তা অধিকার সংক্রান্ত আর একটি বিল ২০১১ থেকে লোকসভায় পড়ে আছে।
সরকারি কর্মীদের দুর্নীতি নিবারণের আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে দুটি ব্যাপারে খেয়াল রাখা দরকার। এক, অসৎ কর্মীদের যেন শাস্তি হয় এবং দুই, সৎ কর্মীদের স্বার্থ যেন সুরক্ষিত থাকে। ১৯৬৪ সালের দুর্নীতি নিবারণ সংক্রান্ত কমিটি তথা সান্তানম কমিটির সময় থেকেই নীতিকারদের এই দুটি বিষয়ে সচেতন করা হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে আইনি কাঠামোর মধ্যে এই বিষয়গুলিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যেমন, যথাক্রমে ১৯৬৪ ও ১৯৬৮ সালে প্রণীত কেন্দ্রীয় আমলা এবং সর্বভারতীয় আমলাদের আচরণ সংক্রান্ত আইন দুটিতে এই প্রশ্নগুলি সম্পূর্ণ উপেক্ষিত থেকে গেছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে একটি প্রশ্ন বিচার করা যাক: সরকারি সংস্থা পরিচালনার বোর্ডে কি কর্মরত আমলাদের মনোনয়ন দেওয়া উচিত? কিংবা, দুর্নীতি নিবারণ আইনে ব্যবস্থা নিতে গেলে এই আইনের ১৯ ধারা অনুসারে আদালতকে আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হয়। অনুমোদন পেতে অনেক সময় দেরি হয়। অনুমোদন নিয়ে পদ্ধতিগত প্রশ্ন তুলে অভিযুক্তের মুক্তির জন্য সওয়াল করা হয়ে থাকে। বিচারে অনেক সময় লাগে। সংবিধানের ৩১১ ধারার কারণে কোনও আমলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া বেশ কঠিন। দণ্ডদানের হার খুব কম। দ্বিতীয় প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন এই বিষয়গুলি পর্যালোচনা করে চতুর্থ রিপোর্টে নির্দিষ্ট কিছু সুপারিশ করেছিল। অন্য দিকে, সৎ অফিসারদের কী ভাবে সুরক্ষা দেওয়া যায়, সেটাও বড় প্রশ্ন। দুর্নীতি নিবারণ আইনের কয়েকটি ধারায় অভিযুক্তের ওপর নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণের দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সমস্যা আছে অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের আইনি সুরক্ষা নিয়েও।
দুর্নীতির রকমফেরও আছে। বেশির ভাগ ছোটখাটো দুর্নীতির ক্ষেত্রে দেখা যায়, একচেটিয়া কর্তৃত্ব কিংবা ব্যক্তিগত বিচারবুদ্ধি অনুসারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমিয়ে স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতা বাড়াতে পারলেই সমস্যার অনেকখানি সুরাহা হয়। কিন্তু এটাও ঠিক যে, একটা স্তরের ওপরে সরকারি অফিসারদের হাতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার ছাড়তে হয়, সব কিছু নিয়ম বেঁধে ঠিক করে দেওয়া যায় না। এখানেই সমস্যা দেখা দেয়।
দ্বিতীয় প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনের বিভিন্ন রিপোর্টের সুপারিশগুলি সরকার রূপায়ণ করলেই সবচেয়ে ভাল হত। তা হয়নি বলেই আমলা তথা সরকারি কর্তাদের পেশাগত সুরক্ষার স্বার্থে সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন করা হয় এবং গত বছর ৩১ অক্টোবর কোর্ট রায় দেয়। আদালত নির্দেশ দেয়, কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের জন্য একটি সেন্ট্রাল সার্ভিসেস অথরিটি তৈরি করতে হবে, একটি সিভিল সার্ভিসেস অ্যাক্ট প্রণয়ন করতে হবে এবং আমালাদের একই পদে একটা ন্যূনতম সময় বহাল রাখতে হবে, তার আগে বদলি করা চলবে না। এ ছাড়াও সুপ্রিম কোর্ট আমলাদের বলেন, তাঁরা যেন কারও মৌখিক নির্দেশে কোনও কাজ না করেন। বড় ব্যবসায়ীরা বা ক্ষমতাবান অন্য কেউ যাতে সরকারি কর্তা ও কর্মীদের ওপর অন্যায় প্রভাব খাটাতে না পারেন, সে জন্য কিছু প্রাতিষ্ঠানিক বন্দোবস্তের কথাও বলেছে সর্বোচ্চ আদালত।
সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের সম্পর্কে বিচারবিভাগীয় অতিসক্রিয়তার অভিযোগ তোলা যায়। এটাও ঠিক যে, কিছু কিছু সুপারিশ কার্যকর করতে গেলে সরকারি কাজের দক্ষতা ব্যাহত হতে পারে। কিন্তু সমস্যার মূলে আছে কেন্দ্রীয় সরকারের নিষ্ক্রিয়তা। প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনগুলির সুপারিশ কার্যকর করার যথার্থ কোনও চেষ্টা দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকার করেনি। কিছু কিছু সংস্কার রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারে পড়ে ঠিকই, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারও চাইলে অনেক কিছু করতে পারত। সৎ আমলাদের রক্ষাকবচ দিতে পারত। তা হলে তাঁরা সাহস করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। সেটা হয়নি।

দিল্লিতে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ অর্থনীতিবিদ


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.