এটা ঠিকই যে, ভারতীয় ধর্মশাস্ত্রে, প্রাচীন সাহিত্য ও ইতিহাসে সমকামী যৌনাচারের কিছু কিছু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। (‘ভিনদেশি’, গৌতম চক্রবর্তী, রবিবাসরীয়, ১৫-১২) যে হেতু সমাজে সমকামীদের উপস্থিতি ছিল, ফলে স্বাভাবিক ভাবেই শাস্ত্রকারেরা তাঁদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারেননি। কিন্তু যাঁরা বলছেন, ‘সমকামিতা’ ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় না, তাঁদের এই ধারণা হল কেন? বিষয়টা একটু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করি।
প্রাচীন ধর্মশাস্ত্র, মহাকাব্য এবং পুরাণে সমকামিতার উল্লেখ রয়েছে সেটা যেমন ঠিক, তেমনই একটু তলিয়ে দেখলে আমরা বুঝতে পারব একে এমন কিছু মহিমান্বিত করা হয়নি যার উপর ভিত্তি করে বলা যাবে যে, সমকামিতা সমাজে অত্যন্ত আদৃত ছিল। শাস্ত্রকারেরা এদের উপস্থিতি বা অস্তিত্বকে অস্বীকার করেননি, করা যায়নি। কারণ, এটা মানুষের এক ধরনের জৈবমানসিক ও যৌনমানসিক প্রবৃত্তিবিশেষ যা তাঁদের বিসমকামীদের থেকে আলাদা করেছে। প্রাচীন মানুষদের পক্ষে হয়তো বোঝা সম্ভব হয়নি, কিন্তু সভ্যতার গোড়াপত্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই তৃতীয় প্রকৃতির মানুষদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছিল। অর্থাৎ সমকামীরা বরাবরই সমাজে ছিলেন, শুধু চিহ্নিত করতে সময় লেগেছে।
প্রাচীন কালে অনেক রাজা-মহারাজাই পুরুষে উপগত হতেন। মধ্যযুগেও রাজা-বাদশা, আমির-ওমরাহ, খলিফাদের মধ্যে এর উপস্থিতি টের পাওয়া গেছে। কিন্তু সমাজে সমকামিতার চর্চা ছিল বলেই তা সমাজ স্বীকৃত একটা অভ্যাস ছিল এমন কথা বলা কঠিন। |
মনুসংহিতায় সমলিঙ্গ যৌন সম্পর্ককে গর্হিত অপরাধ বলা হয়েছে এবং এর জন্য শাস্তির বিধান ছিল। সেই জন্য প্রকাশ্যে কেউই স্বীকার করতেন না। কিছুটা যেন লোকচক্ষুর আড়ালেই গোপনীয়তা রক্ষা করে সমকামী যৌনতার চর্চা চলত। যাঁরা বলছেন, ‘সমকামিতা ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় না’, উপরোক্ত কারণগুলির জন্যই হয়তো তাঁদের এই ধারণা তৈরি হয়েছে।
পৃথিবীর আরও নানা দুটি ধর্মে সমকামী যৌনাচারকে গর্হিত অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। প্রাচীন গ্রিস, রোম, মধ্যপ্রাচ্যে এবং ভারতেও একটা নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে এর বাড়বৃদ্ধি লক্ষিত হলেও শাস্ত্রকারেরা একে নিয়ন্ত্রণ করারও চেষ্টা করেছেন। তাঁদের মনে একটা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ, পুরুষে পুরুষে মিলনে নতুন প্রজন্মের আগমন ঘটে না। তাই এই মানসিকতার প্রসার ঘটলে এক সময় হয়তো মানবজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই আতঙ্ক থেকেই ধর্মগুরুরা সমলিঙ্গের প্রেমকে নিষিদ্ধ করেন এবং তার ফলে সমলিঙ্গ যৌনতার যে ধারা চলছিল তা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকে।
কিন্তু সমকামিতার মতো একটা জ্বলন্ত বাস্তবকে অস্বীকার করার মতো অর্বাচীনতাকে কি আমরা প্রশ্রয় দেব? না কি সমকামীদের যে দাবি, তাকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার করে তাঁদের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করব? আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় কি খায় না, কিংবা ধর্মশাস্ত্রে উল্লেখ আছে কি নেই— এই সব অপ্রয়োজনীয় তর্ক সরিয়ে রেখে একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে দাঁড়িয়ে আমাদের অনুধাবন করতে হবে সারা বিশ্ব কোন পথে চলেছে। সমকামিতাকে এখন অসুস্থতা বলে গণ্য করা হয় না। ইউরোপের বহু দেশে আজ সমকামীদের অধিকার স্বীকৃত। সমকামী বিবাহও অনেক দেশ মেনে নিয়েছে। ২০১৪ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম সমকামী বিবাহ অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। পাশ্চাত্য দেশগুলির উপরোক্ত ঘটনা প্রবাহের কোনও অভিঘাত আমাদের সামাজিক পারিপার্শ্বে পৌঁছবে না? |
অলোক ভট্টাচার্য। কলকাতা-৪২
|
উৎসবের দিনগুলিতে চার দিক যখন আনন্দের বন্যায় ভেসে যায়, সেই মুহূর্তে এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে অবসাদ ঘনিয়ে আসার যে কারণগুলি বিশ্লেষিত হয়েছে (‘উৎসব যাঁদের মনে অবসাদ নিয়ে আসে’, পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়, ১-১) তা যথাযথ। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে একটা কথা বলা দরকার। আর্থিক অনটনও মানুষকে অববসাদগ্রস্ত করে তোলে। কারণ, ইচ্ছে থাকলেও অনেক সময় অভাবের সংসারে উৎসবের আনন্দে অংশ নেওয়ার ক্ষমতা থাকে না। আর এই অক্ষমতা থেকে আসে হতাশা এবং হতাশা থেকে অবসাদ। |
সুব্রতকুমার করণ। বাওয়ালী,
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা |