সমলিঙ্গের জীবের মধ্যে যৌন আকর্ষণ সন্তান উৎপাদনের সহায়ক নয়। তা হলে সমকামী আচরণ
তো প্রকৃতি থেকে মুছে যাওয়ার কথা। তা তো যায়নি। কেন? এ এক প্রহেলিকা। তার
সামনে চার্লস রবার্ট ডারউইন সাহেবও অসহায়। লিখছেন
পথিক গুহ |
একই সময়ে দু’দেশের দু’রকম রায়। ইংলন্ডে রানির কাছে মরণোত্তর ক্ষমা পেলেন বিজ্ঞানী অ্যালান টুরিং। সমকামিতার ‘অপরাধে’ যাঁর শাস্তি হয়েছিল ১৯৫২ সালে। যাঁকে দেওয়া হয়েছিল যৌনতা-প্রশমনকারী ইঞ্জেকশন। হতাশায় যিনি আত্মহত্যা করেছিলেন ৪১ বছর বয়সে। বিলম্বে হলেও, তাঁকে ক্ষমা করে ইংলন্ড বুঝিয়ে দিল, সে দিন শাস্তি দিয়ে আসলে অপরাধ করেছিল রাষ্ট্র। আর ভারতে? এখানে সুপ্রিম কোর্টের ঘোষণার পরিণাম: সমকামিতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেন? ‘হুয়েভার ভলানটারিলি হ্যাজ কারনাল ইন্টারকোর্স এগেনস্ট দি অর্ডার অব নেচার...’ সমকামিতা বিষয়ে ভারতের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের সাম্প্রতিক রায়ের স্বপক্ষে যে যুক্তি পেশ করা হয়েছে, তা ওই ‘অর্ডার অব নেচার’। প্রকৃতির নিয়ম। দুই বিচারপতি জি এস সিংভি এবং সুধাংশুজ্যোতি মুখোপাধ্যায় মনে করেন সমকামিতা প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ। কোন নিয়ম? রায়ে তা উহ্য থাকলেও, আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয় না। রায়ের অন্তর্নিহিত দাবি এই যে, বিপরীত লিঙ্গের প্রাণীর মধ্যে যৌন আকর্ষণই প্রকৃতির নিয়ম। তার বাইরে আর কোনও আকর্ষণ প্রকৃতি-বিরুদ্ধ। তা হলে, যুক্তির স্তম্ভ বলতে দু’টি জিনিস। প্রকৃতি এবং নিয়ম।
সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবির নায়ক অরিন্দম-এর কথা ধার করে বলা যায় ‘পাবলিক’ বস্তুটার মতো ওই প্রকৃতি এবং নিয়ম জিনিসগুলোও বড় গোলমেলে। প্রথমে আসা যাক নিয়ম প্রসঙ্গে। বিপরীত লিঙ্গের প্রাণীর মধ্যে যৌন আকর্ষণের ছড়াছড়ি দেখে ভ্রম হওয়া স্বাভাবিক যে, ওটাই বুঝি দস্তুর। কিন্তু, বাস্তব যে অন্য কথা বলে। মানুষের কথা বাদ থাক। অন্য প্রাণীর সংসারেও যে সমলিঙ্গের সদস্যদের মধ্যে যৌন আকর্ষণ অমিল নয়। বোনোবো, ডলফিন, পেঙ্গুইন, ব্যাঙ, সাপ, কেঁচো, ভেড়া এবং বহু পোকার জগতে সমকামিতা রীতিমতো স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। দু-একটি পোকার ক্ষেত্রে গবেষণা করতে গিয়ে বিস্মিত হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। দেখেছেন, পুরুষদের জননেন্দ্রিয়ের গঠন এমন ধরনের যে তা সমকামী আচরণকে প্রশ্রয় দেয়। |
নিয়মবিরুদ্ধ নয় বটে, তবে সমকামিতা কিন্তু বড় একটা ধাঁধা। কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে আসতে হবে প্রকৃতি প্রসঙ্গে। প্রকৃতিতে মূল কথা টিকে থাকা। সারভাইভাল। প্রাণী অমর নয়, নশ্বর। প্রকৃতিতে অমরত্বের বন্দোবস্ত বংশবৃদ্ধিতে। তাই বংশবৃদ্ধি সবার কাম্য। সমকামিতা প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়ায় ঠিক এখানে। সমলিঙ্গের জীবের মধ্যে যৌন আকর্ষণ সন্তান উৎপাদনের সহায়ক নয়। যেমন সহায়ক নয় আত্মহত্যা কিংবা অনাত্মীয়ের সন্তানকে দত্তক নেওয়ার প্রবণতা। সুতরাং, ওই দু’টি কাজের মতো সমকামী আচরণ তো প্রকৃতি থেকে মুছে যাওয়ার কথা। তা তো যায়নি। কেন? বড় প্রশ্ন।
এ এক এমনই বড় প্রহেলিকা যে, তার সামনে চার্লস রবার্ট ডারউইন সাহেবও অসহায়। বিজ্ঞানে এক মহাবিপ্লবের নায়ক নিকোলাস কোপারনিকাস। গ্রহ-তারার নতুন অনুশাসন তাঁর অবদান। তবু সে বিপ্লবের প্রভাব ছিল সীমিত। যেন তা কেবল জড় বস্তুর জন্য। জীবজগতের রহস্য ব্যাখ্যায় তা অচল। যেন লতা-পাতা গাছ-পালা পশু-পাখির রাজ্যে বিজ্ঞানের কথা বলার কোনও অধিকার নেই। সেখানে খবরদারি করতে পারবে কেবল ধর্মবিশ্বাস। এই পরিস্থিতির অবসান ঘটান ডারউইন। দেখিয়ে দেন জীবজগতের হাল-হকিকতের ব্যাখ্যাও দিতে পারে বিজ্ঞান। দিতে পারে বিবর্তনবাদের আলোকে। যার মূল কথা বংশবৃদ্ধি। এমন ভাবে, যাতে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে টিকে থাকা যায়। যে-সব বংশধর পরিবেশের উপযোগী নয়, তারা পৃথিবীর বুকে নিশ্চিহ্ন হতে বাধ্য। এ তত্ত্ব এত বড় মনে করেন এ যুগের দার্শনিক ড্যানিয়েল ডেনে যে, তিনি বলেছেন, ‘আমার তাস খোলাখুলি টেবিলে রাখছি। আবিষ্কৃত মানুষের সেরা একটি ধারণার জন্য আমি যদি কোনও পুরস্কার দিই, তা হলে আমি আইজাক নিউটন, আলবার্ট আইনস্টাইন বা অন্য কারও পরিবর্তে তা দেব ডারউইনকে।’ এ হেন ডারউইনের তত্ত্ব ব্যাখ্যা দিতে পারে না সমকামিতার। পরিবেশের অনুপযোগী বংশধর আর বংশবৃদ্ধির অনুপযোগী প্রবৃত্তি তো প্রায় একই ব্যাপার। তা হলে বিবর্তনের চাপে তো জীবজগতে সমকামিতা উধাও হওয়ার কথা। কিন্তু তা তো বেঁচেবর্তে আছে দিব্যি।
ঠেলায় পড়ে গবেষকেরা সমকামিতার মধ্যে বিবর্তনোপযোগী কিছু গুণাগুণ খুঁজে বের করেছেন বটে, তবে সে-সব কতটা গ্রহণযোগ্য, তা বিচার্য। যেমন, ওঁরা বলছেন, সমকামিতা বিপরীত লিঙ্গের এক জনের প্রতি অনেকের আকর্ষণ কমায়। এতে জীবসমাজে সমলিঙ্গের সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ কমে। সমাজ হয় সুসংবদ্ধ। টিকে থাকার উপযোগী। জবরদস্ত ব্যাখ্যা কি? মানা যায় না।
জীবজন্তুর সমাজে সমকামিতা সম্পর্কে ডারউইন কোনও মন্তব্য করেছিলেন কি না তা জানা নেই। তবে, ভারতের শীর্ষ আদালতের দুই বিচারপতি যে-ব্যবস্থাকে নিয়ম আখ্যা দিয়েছেন, তার বিশেষ একটি দিক সম্পর্কে বিবর্তনবাদের গুরু কিন্তু অকপটে বিজ্ঞানের ব্যর্থতা স্বীকার করেছিলেন। কোন দিক? সেক্স। প্রজননের মূলে দুই বিপরীত লিঙ্গের মিশ্রণ। সন্তান উৎপাদনে স্ত্রী এবং পুরুষ দুই প্রজাতির প্রয়োজন। ১৮৬২ সালে ডারউইন লিখেছিলেন, ‘যৌনতার কারণ সম্পর্কে আমরা চূড়ান্ত কিচ্ছুটি জানি না। নতুন জীবের জন্মের জন্য কেন দুই লিঙ্গের মিশ্রণ দরকার? পুরো বিষয়টা এখনও অন্ধকারে ঢাকা।’ ডারউইনের ওই মন্তব্যের পর দেড়শো বছর কেটেছে। ওই অন্ধকার আজও কাটেনি। হোয়াই সেক্স?
বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে যাঁরা খড়্গহস্ত, আমেরিকায় যাঁরা জিগির তোলেন স্কুলে পাঠ্য-তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে ওই বিষয়, তাঁরা মহা খুশি বিজ্ঞানের ওই ব্যর্থতায়। ওঁরা ‘ক্রিয়েশনিস্ট’, আস্থা রাখেন সৃষ্টিবাদে, ওঁদের দাবি ‘হোয়াই সেক্স’ প্রশ্নের একমাত্র উত্তর ঈশ্বর। আদম আর ইভ-এর মতো বিপরীত লিঙ্গের জীব ঈশ্বরের সৃষ্টি। যেহেতু তাঁর ইচ্ছা ওদের সন্তান আসার মূলে ভূমিকা থাক কারও একার নয়, দুজনের; তাই বংশধর সৃষ্টির জন্য দরকার বাবা ও মা-র। সৃষ্টিবাদীরা ঘোরতর আস্তিক। বিশ্বাস করেন পৃথিবীতে মানুষ অন্য জীবের বিবর্তনে আসেনি, বরং এসেছে ঈশ্বরের সৃষ্টি হিসেবে। অর্থাৎ, যে বিশ্বাস ভেঙেচুরে দিয়েছিলেন ডারউইন। এ কারণে তিনি ওঁদের চিরশত্রু।
সেই ডারউইন যদি কোনও প্রশ্নে নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করেন, তা হলে ওঁদের উল্লাস দেখে কে! সমকামিতা সৃষ্টিবাদীদের চোখে নিন্দনীয়, কারণ ওটা নাকি জীবের ঘৃণ্য বিকার। কেন? ওতে ঈশ্বরের অভিপ্রায় (সন্তান উৎপাদন) সিদ্ধ হয় না।
হোয়াই সেক্স প্রশ্নে সৃষ্টিবাদীদের অতি-সরল উত্তর অগ্রাহ্য করলেও ওটা যে ধাঁধা হিসেবে জবরদস্ত, তা মানেন অনেকে। ওটাকে আখ্যা দেন ‘কুইন অব ইভল্যুশনারি প্রবলেমস’। রানিই বটে। প্রকৃতি মানে যদি হয় কেবল বংশবৃদ্ধি আর টিকে থাকার সাফল্য, তা হলে বিপরীত লিঙ্গের মিশ্রণে সন্তান সৃষ্টি মোটেই মসৃণ পন্থা নয়। কেন, তা ব্যাখ্যা করা যাক।
দুই লিঙ্গের মিশ্রণ মানে একের দ্বারা কিছু হবে না। প্রয়োজন দুইয়ের। তাই সন্তানের মধ্যে এক জনের জিন সবটা নয়, দু’জনের জিন আধাআধি পরিমাণে। ক্ষতি আরও। দুই বিপরীত লিঙ্গের মিশ্রণে ফসল কেবল স্ত্রী প্রজাতি নয়, স্ত্রী এবং পুরুষ— এই দুই লিঙ্গের প্রজাতি। এর বদলে যদি স্ত্রী থেকে জন্মাত কেবল স্ত্রী— যেমনটা হয় ক্লোনিং-এ— তা হলে এক নাগাড়ে বেড়ে চলত স্ত্রীর সংখ্যা। বংশধরে আধাআধি ভাগ বসাত না পুরুষরা। স্ত্রীর প্রজনন ক্ষমতার এই যে অর্ধেক সদ্ব্যবহার, একে বিজ্ঞানীরা বলেন ‘টু-ফোল্ড কস্ট অব সেক্স’। লিঙ্গ মিশ্রণের ডবল দাম।
হ্যাপা কি শুধু ওতে? পুরুষ হলে স্ত্রী, স্ত্রী হলে পুরুষ, খোঁজার ঝক্কি নেই? সেক্স থাকায় পৃথিবী বর্ণময় হয়েছে বটে, শুধু ক্লোনিং-এ বংশবৃদ্ধি হলে পরিবেশ বৈচিত্রহীন হত নিশ্চয়ই। তবে যে কারণে এত রং-রূপ, সেই সঙ্গীসন্ধান কাজটা যে বেশ ঝামেলার। মানুষের বেলায় যদি থাকে প্রেম নিবেদন থেকে নিজেকে অন্যের তুলনায় যোগ্যতর প্রমাণের দীর্ঘ পথ পরিক্রমা, তো অন্য জীবের বেলাতেও সেটা কম নয়। জোনাকি আলো ছড়ায়, ব্যাঙ ঘ্যাঙর-ঘ্যাং ডাকে, সঙ্গী খুঁজতে। ফুল সুগন্ধ ছড়ায়, যাতে কীট তার কাছে এসে পরাগরেণু বয়ে নিয়ে যায় অন্যের কাছে। আর ময়ূরের পেখম? সে তো একটা পেল্লায় বোঝা। যে বোঝা নিয়ে জঙ্গলে বাঘ-সিংহের আক্রমণ হলে পালিয়ে বাঁচা কঠিন। তবু ও-রকম বোঝা কেন? স্রেফ ময়ূরীর মন জয় করতে। গান গেয়ে বা গন্ধ ছড়িয়ে যে সময় নষ্ট, তা কাজে লাগানো যেত খাবার খুঁজে। পেখমের মতো বোঝার বদলে ঠ্যাং করা যেত বেশি লম্বা, অথবা ঠোঁট বেশি ছুঁচোলো। টিকে থাকায় সাহায্য করত ও-সব। তার বদলে সেক্স!
ডারউইন দেড়শো বছর আগে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও, সেক্স ধাঁধা সমাধানে গবেষকেরা কোমর বেঁধে নেমেছেন চার-পাঁচ দশক আগে। কতকগুলো ব্যাপার ভাবাচ্ছে ওঁদের। বিপরীত লিঙ্গের মিশ্রণই বংশবৃদ্ধির একমাত্র নিয়ম নয়। দু-একটি গাছ কিংবা অন্য প্রাণী এখনও সেক্স এড়িয়ে বংশবৃদ্ধি করে। বড় উদাহরণ ব্যাকটেরিয়া। কয়েকশো বছর ধরে তা টিকে আছে স্রেফ ক্লোনিং পন্থায়। সেক্স পৃথিবীতে প্রাণের আদি পর্বে ছিল না। ভূতত্ত্ব থেকে প্রমাণ তা এসেছে দুশো কোটি বছর আগে।
কেন তা এল? বেশ কিছু উত্তরের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে এক থিয়োরি। যার মূল কথা সেক্স রোগভোগের বিরুদ্ধে টোটকা। কী রকম? সেক্স মানে একগুচ্ছ নিজের হাজারো লাখো কপি নয়, নানা জিনের খিচুড়ি। এক জিনের বহু কপি রোগের সামনে পড়লে একসঙ্গে সবার এন্তেকাল। আর জীব মিশ্র জিনের আধার হলে, এক রোগে সবাই হবে না কুপোকাত। মিশ্র জিন, সুতরাং, প্রতিকূল পরিবেশে বলীয়ান। এ তত্ত্বেরও আবার ছিদ্র আছে। মা-র থেকে মেয়ের যুগে পরিবেশ কী এমন পাল্টায় যে নিশ্চিহ্ন হবে মেয়েরা? সুতরাং, বিতর্ক জারি। এবং সেক্স এখনও এক ধাঁধা।
নাহ্, প্রকৃতি ও নিয়ম, কাউকেই এক ছাঁচে ফেলা যাচ্ছে না। |