পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরনগরে সাম্প্রদায়িক হানাহানির পর তিন মাসেরও অধিক কাল অতিবাহিত। এখনও অন্তত পনেরো হাজার শরণার্থী বিভিন্ন ত্রাণ-শিবিরে পড়িয়া আছেন। ঘরে ফেরার কোনও তাগিদই তাঁহারা বোধ করিতেছেন না। ইহার দ্বিবিধ কারণের কথা বলা হইতেছে। প্রথমত, রাজ্য সরকার তথা প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাহারা দাঙ্গাধ্বস্ত শরণার্থীদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের কোনও বন্দোবস্ত করিতেছে না। দ্বিতীয়ত, কায়েমি স্বার্থবাদী কিছু ব্যক্তি ও সংগঠন এককালীন ত্রাণসাহায্য প্রাপ্তির আশায় শরণার্থীদের শিবিরেই থাকিয়া যাইতে উৎসাহিত করিতেছেন, যাহাতে ওই ত্রাণের অর্থের ভাগ তাঁহাদেরও হস্তগত হয়। দুইটি ক্ষেত্রেই অবশ্য শেষ বিচারে দায়িত্বের ভাগী হইতে হইবে সরকারকেই, নিরপেক্ষ ভাবে রাজধর্ম অনুশীলনের পরিবর্তে যে-সরকার সক্রিয় ভাবে রাজনৈতিক পক্ষপাত ও মেরুকরণ অনুশীলন করিয়া চলিয়াছে। ইহা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং আপত্তিকর।
প্রথমাবধি রাজ্য সরকারের দায়িত্ব ছিল, দুর্গতদের ত্রাণে তৎপর হওয়া। তেমন কোনও উদ্যোগ কিন্তু দেখা যায় নাই। দাঙ্গা-কবলিতরা যে দুই বেলা দুই মুঠা অন্নের সংস্থান করিতে পারিয়াছেন, সেটা সম্ভব হইয়াছে বিভিন্ন বেসরকারি, ইসলামি সেবা-প্রতিষ্ঠান, জমিয়তে উলেমা-এ-হিন্দ-এর মতো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদার বদান্যতায়। অখিলেশ যাদবের সরকার দাঙ্গা-দুর্গতদের ত্রাণে যে নিস্পৃহ ঔদাসীন্য ও নিশ্চেষ্টতা দেখাইয়াছে, তাহা চমকপ্রদ। দায় পালনে অস্বীকৃত হওয়ার এক্তিয়ার কোনও সরকারের নাই। কিন্তু উত্তরপ্রদেশের শাসক দলের আচরণ দেখিয়া সংশয় হয়, তাহারা ভোটের অঙ্ক কষিতে এতটাই মগ্ন থাকিয়াছে, দুর্গতদের কেবল সাম্প্রদায়িক ভোটার হিসাবে গণ্য করার প্রয়াসে এত মজিয়া থাকিয়াছে যে, দুর্গতির মধ্যেই তাহাদের ফেলিয়া রাখিয়া সেই দুর্গতির জন্য প্রতিপক্ষ রাজনীতিকদের মদতেপুষ্ট দাঙ্গাবাজদের দোষী শনাক্ত করিতে ব্যস্ত থাকিয়াছে। ত্রাণশিবিরের আশেপাশেই সরকারি জমিতে জবরদখল ও পুনর্বাসনের বেআইনি প্রক্রিয়ায় উস্কানি দিতেছেন পঞ্চায়েতের নির্বাচিত গ্রামপ্রধান, যিনি শাসক দলেরই সদস্য।
সমগ্র ঘটনাক্রমে স্পষ্ট, উত্তরপ্রদেশের সরকার প্রজাহিতের ব্রত হইতে বিচ্যুত। অথচ প্রজাহিত কেবল পুণ্যের বাহন নয়, জনসমর্থন কুড়াইবারও একটি মাধ্যম হইতে সমর্থ। জনসমর্থনের লক্ষ্যেও জনকল্যাণের দিকে তাকাইলে দুর্গতদের ঘরে ফেরার প্রক্রিয়া সুনিশ্চিত করিবার কথা। প্রত্যাবর্তনের অসুবিধা ও আপত্তিগুলি খতাইয়া দেখা দরকার। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট অসরকারি সংগঠনগুলির পরামর্শ লওয়া সম্ভব, প্রয়োজনীয় সহযোগিতার লক্ষ্যে। তবে সর্বাগ্রে দরকার সরকার তথা শাসক দলকে দুর্গতদের লইয়া রাজনীতি করার মতলব পরিহার করা। মুজফ্ফরনগরকে দেখাইয়া ইতিমধ্যেই দেশময় রকমারি রাজনৈতিক সংকীর্ণতা শুরু হইয়াছে। দাঙ্গাপীড়িত মুসলিম তরুণদের লস্কর-এ-তইবার স্বেচ্ছাসেবক বানাইবার ‘ষড়যন্ত্র’র কথাও শুনা যাইতেছে। ভোটারদের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের গল্পটি তো আগে হইতেই চালু। এই সব অপপ্রয়াসের বৃত্তের বাহিরে দাঁড়াইয়া নিরপেক্ষ ভাবে দুর্গতত্রাণে তৎপর হইতে হইবে। অন্যথায় মুলায়ম সিংহ যাদবের উত্তরসূরির পক্ষে রাজধর্ম পালনের গৌরব অর্জনের সম্ভাবনা দূরপরাহতই থাকিয়া যাইবে। |