রাজ্য মানবাধিকার কমিশনে চেয়ারম্যান অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের ইস্তফাপত্রটি পৌঁছাইবার সঙ্গে সঙ্গে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হইল। ন্যায়ের ধুয়া তুলিয়া অন্যায় প্রতিষ্ঠার ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত। কী ভাবে এক জন উচ্চপদস্থ ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিচারহীন অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁহাকে নিজের কাজ ও নিজের কর্মস্থল হইতে খেদাইয়া বাহির করিতে হয়, বিভিন্ন পার্শ্বিক চাপের সাঁড়াশিতে ডাকিনী-তাড়না সিদ্ধ করিতে হয়, তাহার দৃষ্টান্ত। তর্কের খাতিরে যদি ধরিয়া লওয়া যায় যে, শ্রীযুক্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, তাহা সত্য, তাহা হইলেও বলিতেই হয় যে, প্রত্যক্ষ প্রমাণহীন কোনও অভিযোগের যথাযোগ্য বিচার ছাড়া অভিযুক্তকে শাস্তিদান সভ্য সমাজের রীতি বা নীতি হইতে পারে না। নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগের গুরুত্ব দেখিয়া অভিযুক্ত ব্যক্তি নিশ্চয়ই আত্মমর্যাদার খাতিরে পদত্যাগ করিতে পারেন, কিন্তু অভিযোগ উঠিয়াছে বলিয়াই তিনি এখনই পদত্যাগ করুন, এই মর্মে তীব্র চাপ দেওয়া অত্যন্ত অসঙ্গত, অনৈতিক। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার, অন্য নানা দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, সকলে মিলিয়া লাগাতার তাহাই করিয়া গেলেন। এবং অবশেষে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সুবিচারের সম্ভাবনাকে অনাচার ভাসাইয়া লইয়া গেল, জয়ী হইল চাপের রাজনীতি।
কেন এই চাপের রাজনীতি? কিছু পরিপ্রেক্ষিত মনে রাখা জরুরি। রাজ্য মানবাধিকার কমিশন একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, নিরপেক্ষ অবস্থান হইতে মানবাধিকার-সংক্রান্ত প্রশ্নগুলি বিচার করিবার অর্থ প্রকৃতপক্ষে প্রশাসনিক অন্যায়ের বিরোধিতা ও মোকাবিলা। যে কোনও সরকারের পক্ষেই মানবাধিকার একটি অতি সংবেদনশীল বিষয়, দুইয়ের মধ্যে সদ্ভাব সতত অনুপস্থিত। রাজ্য সরকারের সহিত এমন প্রতিষ্ঠানের প্রীতি-সম্পর্ক না থাকা, বিশেষত যেখানে প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসাবে প্রাক্তন বিচারপতি শ্রীযুক্ত গঙ্গোপাধ্যায় ইতিমধ্যে নিজেকে যথেষ্ট নিরপেক্ষ, দক্ষ ও কড়া কর্তা হিসাবে প্রমাণ করিয়াছেন। গত আড়াই বৎসরে একাধিক বার তাঁহার সহিত রাজ্য সরকারের এই অ-প্রীতি দেখা গিয়াছে। অম্বিকেশ মহাপাত্রের ঘটনাতেই হউক, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় পর্বেই হউক, কমিশনের কোনও সুপারিশেই রাজ্য সরকার কর্ণপাত করে নাই, ব্যক্তিগত ভাবেও চেয়ারম্যানের প্রতি সরকারি অশ্রদ্ধা প্রকাশিত হইয়াছে। সম্প্রতি তাঁহার পাকিস্তান-গমন সূত্রে অভিযোগ উত্থাপনের পিছনেও এই কু-সম্পর্কের ছায়া। সন্দেহ স্বাভাবিক যে, প্রতিক্রিয়ার সবটাই অন্যায়ের প্রতিকারের পবিত্র ক্রোধে উদ্দীপ্ত নহে, সম্ভবত নেপথ্যমঞ্চে অন্য হিসাবের খেলাও চলিতেছে।
শুধু রাজ্য সরকার? টুজি স্পেকট্রাম বণ্টন সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় ও জি এস সিংভি যে রায় দিয়াছিলেন, তাহা ইউ পি এ তথা কংগ্রেসের ভাবমূর্তিকে প্রচণ্ড আঘাত করিয়াছিল, যাহার ধাক্কা মনমোহন সিংহ বা সনিয়া গাঁধী আজও সামলাইতে পারেন নাই। যৌন হেনস্থার অভিযোগকে কেন্দ্র করিয়া দিল্লীশ্বররা যাহা করিলেন, যে ভাবে করিলেন, তাহা কি সুযোগসন্ধানী প্রত্যাঘাত? আরও এক ধরনের প্রত্যাঘাতের সংকেতও উড়াইয়া দেওয়া যায় না। গত কয়েক বছরে বিচারবিভাগের বিভিন্ন রায় এবং অনুশাসন ক্ষমতাবান বর্গের বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানেরই ক্ষোভ উৎপাদন করিয়াছে, তাহা সুস্পষ্ট। অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রতি গত কিছু দিন ধরিয়া চতুর্দিক হইতে যে অ-স্বাভাবিক আক্রমণ দেখা গিয়াছে, তাহা হয়তো প্রকৃতপক্ষে বিচারব্যবস্থা তথা তাহার চালকদের উপর সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের ‘প্রতিশোধ’। মেয়েদের যৌন লাঞ্ছনা সম্পর্কে সম্প্রতি জাগ্রত সমাজের চেতনা তাহাতে ইন্ধন জোগাইয়া থাকিতে পারে, কিন্তু নিছক একটি অভিযোগের ভিত্তিতে এতখানি তাড়না— সন্দেহ অস্বাভাবিক নয়। |