|
|
|
|
উন্নয়নের অস্ত্র শানিয়ে সীমান্তে অন্য লড়াই লড়ছেন রক্ষীরা |
অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায় • কলকাতা |
অনুপ্রবেশ রুখতে সীমান্তে আছে কাঁটার বেড়া। সশস্ত্র শত্রুর মহড়া নিতে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, এলএমজি, মর্টার নিয়ে সদা মোতায়েন রক্ষীবাহিনী। বিদেশি চরেদের গুপ্ত বার্তার চালাচালির হদিস পেতে বেতারে অতন্দ্র নজরদারি। কিন্তু সীমান্তবাসী গরিবগুর্বো মানুষগুলোকে দেশবিরোধী কাজকর্মে সামিল করার অদৃশ্য ষড়যন্ত্র রোখার দাওয়াই কী?
একটাই উত্তর উন্নয়ন।
অন্তত নেপাল ও ভুটান সীমান্তের প্রহরী সশস্ত্র সীমা বল (এসএসবি)-এর কর্তাদের তেমনই দাবি। ওঁরা জানিয়েছেন, দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে সীমান্ত-ঘেঁষা ভারতীয় বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দাদের একাংশকে বিপথে চালিত করছিল যে সব দুষ্টচক্র, উন্নয়নের হাতিয়ার ছাড়া তাদের প্রতিহত করা অসম্ভব। তাই অধিবাসীদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সীমান্তের প্রতিটি গ্রামে এসএসবি স্বনির্ভরতা প্রকল্প চালু করতে উদ্যোগী হয়েছে। গরিবদের ছোটখাটো ব্যবসা করে স্বনির্ভর হতে সাহায্য করছে, তাতে মিলছে দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলা পুলিশের সহযোগিতা। গ্রামবাসীদের আগ্রহ দেখে এসএসবি-কর্তৃপক্ষ যথেষ্টই স্বস্তিতে।
কার্গিল যুদ্ধের সময় থেকে ভারতের নানা সীমান্ত দিয়ে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের অনুপ্রবেশ, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় আঘাত, চোরাচালান ও জাল নোট ছড়ানোর সুস্পষ্ট প্রমাণ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের হাতে আসতে শুরু করে। নেপাল-ভুটান সীমান্তেও জঙ্গি তৎপরতার প্রমাণ মেলে। দার্জিলিং জেলায় ভারত-নেপাল সীমান্তবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রহরার দায়িত্ব ২০০১-এ এসএসবি’র হাতে আসে। ২০০৩-এ ভুটান সীমান্তেও এসএসবি মোতায়েন হয়। বিহার সীমান্ত থেকে দার্জিলিং-সিকিম হয়ে জলপাইগুড়ি পর্যন্ত প্রায় ছ’শো কিলোমিটার লম্বা নেপাল ও ভুটান সীমান্ত জুড়ে ১৪০টি সীমান্ত-চৌকি। বাহিনী-সূত্রের খবর: গত তিন বছরে নেপাল ও ভুটান সীমান্তে প্রচুর ব্রাউন সুগার, গাঁজা, জাল নোট, জিলোটিন স্টিক উদ্ধার হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে শ’ছয়েক সন্দেহভাজনকে। গোয়েন্দারা খবর পেয়েছেন, কেএলও, আলফা-সহ একাধিক জঙ্গি সংগঠনের নেতাদের নিয়মিত নেপালে যাতায়াত রয়েছে। এমনকী, সম্প্রতি ধরা পড়া ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের দুই চাঁই আবদুল করিম টুন্ডা ও ইয়াসিন ভটকলও নেপাল সীমান্তে জঙ্গি-জাল বিছিয়েছিল বলে গোয়েন্দা-সূত্রের দাবি। |
|
গ্রামবাসী-এসএসবি কাঁধে কাঁধ। নেপাল সীমান্তে। —নিজস্ব চিত্র। |
ক্রমে জানা যায়, সীমান্তের ষড়যন্ত্রে দাবার ঘুঁটি করা হচ্ছে সাধারণ গ্রামবাসীদের, যাদের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদীদের কোনও দিনই যোগাযোগ ছিল না। এসএসবি-সূত্রের খবর: দুষ্টচক্র প্রথমে ওঁদের চোরাচালানে হাতেখড়ি দেয়। সহজে উপার্জনের টোপ দিয়ে ধীরে ধীরে তাঁদের চক্রে জড়িয়ে ফেলে। শেষে অস্ত্র-বিস্ফোরক বা জঙ্গি পারাপারের মতো দেশবিরোধী কাজে লাগানো হয়। এবং গোটা প্রক্রিয়ায় চক্রীদের মূল হাতিয়ার গ্রামবাসীদের দারিদ্র্য।
ব্যাপারটা বোঝার পরেই সমস্যাকে শিকড়সুদ্ধ উপরে ফেলার এই প্রয়াস। সে জন্য প্রথমে মানুষের আস্থা অর্জনের চেষ্টা হয়েছে। এসএসবি-র আইজি (শিলিগুড়ি) কুলদীপ সিংহ জানান, সীমান্ত লাগোয়া গ্রামে গ্রামে প্রয়োজনে পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে টহলদারি চলছে নিয়মিত, যাতে অবাঞ্ছিত লোকজনের উপস্থিতি সহজে নজরে পড়ে। বিপদের গন্ধ পেলে গ্রামবাসীরাও চটজলদি বাহিনীর সাহায্য চাইতে পারছেন। এতে সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান যেমন কমেছে, চোলাই মদ তৈরিতেও ভাটা পড়েছে। “সবচেয়ে বড় ব্যাপার, এসএসবি ও গ্রামবাসীদের মধ্যে সম্পর্ক দিন দিন মজবুত হচ্ছে, যা কিনা সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করতে ভীষণ জরুরি।” মন্তব্য আইজি’র।
এর পরে এসেছে উন্নয়ন ও স্বনির্ভরতাদানের পর্ব। কী ভাবে?
এসএসবি-সূত্র জানাচ্ছে, গ্রামে-গ্রামে মোবাইল মেরামতি ও সেলাই শেখানোর কেন্দ্র খোলা হয়েছে। মহিলাদের সেলাই মেশিন দেওয়া হচ্ছে। পাহাড়ি গ্রামগুলোয় জলাভাব বড় সমস্যা। তা নিরসনে পরিস্রুত পানীয় জল জোগানোর বন্দোবস্ত হচ্ছে। খেলাধুলো, স্বাস্থ্যশিবিরের আয়োজন হচ্ছে নিয়মিত। শিক্ষা-সাক্ষরতাতেও নজর দিয়েছে এসএসবি। স্কুল ও গ্রন্থাগার খুলে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েকে বই বিলির পরিকল্পনা রয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষামূলক ভ্রমণে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দেশের অন্য অংশের খবরাখবর, সংস্কৃতি ইত্যাদির সঙ্গে পরিচিত করতে প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে বিতরণ করা হচ্ছে সৌরচালিত ট্রানজিস্টর সেট।
পাল্লা দিয়ে সীমান্ত-গ্রামের বাসিন্দাদের মনোভাবও পাল্টাচ্ছে। কী রকম?
ভুটান সীমান্ত লাগোয়া জলঢাকা নদীর তীরবর্তী ঝালং গ্রামের জিতেন্দ্র লামা, পবিত্র গুরুঙ্গেরা এসএসবি মোতায়েনের পরে কিছুটা ভয়ে ভয়ে ছিলেন। রক্ষীদের থেকে দূরে দূরে থাকতেন। ভেবেছিলেন, তল্লাশির নামে হয়রানি বাড়বে। কিন্তু এখন ওঁরা এসএসবি’কে বন্ধু মনে করেন। ওঁদের কথায়, “বছর কয়েক আগেও স্মাগলারদের ভয়ে রাতে বেরোতে পারতাম না। নিত্য নতুন লোক গ্রামে এসে ঘাঁটি গাড়ত। এসএসবি আসায় রেহাই মিলেছে। ওরা আমাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। আমরাও ওদের সাহায্য করছি।” নেপাল সীমান্ত লাগোয়া পানিট্যাঙ্কির জ্যোতি ছেত্রীর কথাতেও সেই আস্থার প্রকাশ। এসএসবি’র সহায়তায় সেলাই শিখে টাকাপয়সার মুখ দেখেছেন তিনি। “আগে তেমন আয় ছিল না। ইদানীং সেলাই করে ভাল উপার্জন করছি।” উৎসাহে টগবগে তরুণীর স্বর।
জ্যোতি-জিতেন্দ্রদের এই উৎসাহই সীমান্তে চক্রান্ত দমনে বড় ভরসা। |
|
|
|
|
|