তৃণমূলের টিকিট না পেয়ে গত পঞ্চায়েত ভোটে দলেরই বিরুদ্ধে নির্দল প্রার্থী হয়ে ময়দানে নেমেছিলেন। হাসতে হাসতে জিতেও ছিলেন। কিন্তু জয়ের পরে এক দিনের জন্যও দুবরাজপুরের সাহাপুর পঞ্চায়েতের কার্যালয়ে নিজেদের ঘরে ঢুকতে পারেননি এক জনও।
অভিযোগ, দুবরাজপুর পঞ্চায়েত সমিতির জয়ী এক তৃণমূল সদস্যই তাঁদের সেখানে ঢুকতে দিচ্ছেন না। তাঁর ‘হুমকি’র মুখে পড়েই প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা না পেয়ে ঢুকতে সাহস পাচ্ছেন না ওই তিন মহিলা-সহ জয়ী চার নির্দল পঞ্চায়েত সদস্য। এ নিয়ে চার জনেই সংশ্লিষ্ট বিডিও এবং পিডিও-র কাছে দ্বারস্থ হয়েছেন। এমনকী, স্থানীয় সদাইপুর থানাতেও অভিযোগ করেছেন। কিন্তু কোনও তরফেই প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা মেলেনি বলেই ওই চার পঞ্চায়েত সদস্যের দাবি। একই অভিযোগ করছেন আবার পঞ্চায়েতে সমিতির জয়ী কংগ্রেস সদস্যও। তাঁর দাবি, ওই পঞ্চায়েতে তাঁকেও ঢুকতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। দুবরাজপুরের বিডিও কুণাল বন্ধ্যোপাধ্যায় বলেন, “পঞ্চায়েতের কার্যালয়ে ঢুকতে বাধা পাচ্ছেন জানিয়ে ওই পঞ্চায়েতের কয়েক জন সদস্য অভিযোগ করেছিলেন। তবে নির্দিষ্ট করে কারও নামে অভিযোগ করেননি। এলাকায় আইন শৃঙ্খলার কিছুটা অবনতি হয়েছে জেনে, বুধবারই সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠক ডেকেছিলাম। সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করছি।”
ওই পঞ্চায়েতের নির্দল সদস্য শেখ সহরাব আলি, মমতাজ বেগম, অনিতা দাস ও রোকেয়া বিবিরা বলছেন, “এই পঞ্চায়েত এলাকা থেকে জেতা দুবরাজপুর পঞ্চায়েত সমিতির খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ, তৃণমূলের আবুল কালামের দাদাগিরিতে তটস্থ হয়ে আমাদের পঞ্চায়েতে যাওয়া বন্ধ। পঞ্চায়েতে যাতে না যাই, সেই জন্য এলাকায় বোমাবাজি করা, ভয় দেখানো, থেকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি কিছু করতেই তিনি বাদ রাখেননি। সম্পূর্ণ বিরোধী শূন্য পঞ্চায়েতে প্রধান ও উপপ্রধানকে ঢাল করে তৃণমূলের ওই নেতা নিজের ইচ্ছে মতো এলাকা শাসন করছেন। বিডিও, পিডিও এবং পুলিশে বহু অভিযোগ করেও নিটফল শূন্য।” তাঁরা জানাচ্ছেন, প্রথম দিন থেকেই পরিস্থিতি এতটাই আতঙ্কের ছিল যে নিজেদের শপথ নেওয়ার কাজও দুবরাজপুর ব্লকে গিয়ে করতে হয়েছিল। এমনিতে, সদাইপুর থানার অন্তর্গত ওই ওই পঞ্চায়েতে নিয়মিত বোমাবাজি ও রাজনৈতিক সংঘর্ষকে ঘিরে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ লেগেই থাকে।
স্থানীয় ও প্রশাসন সূত্রের খবর, ১৩ আসন বিশিষ্ট ওই পঞ্চায়েতে ৮টি আসন পেয়ে ক্ষমতায় রয়েছে তৃণমূল। ৪টি আসনে জয়ী হন দলীয় টিকিট না পেয়ে নির্দল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা তৃণমূলেরই বিক্ষুব্ধেরা। একটি আসন পায় সিপিএম সমর্থিত নির্দল। কিন্তু ১৬ অগস্ট বোর্ড গঠনের দিন থেকেই সমস্যার সূত্রপাত হয়। বিরোধী সদস্য রোকেয়া বিবি, মমতাজ বেগম, শেখ সহরাব আলিদের অভিযোগ, “ওই দিন যাতে বোর্ড গঠনের দিন অফিসে যেতে না পারি, আমাদের প্রত্যেকের বাড়ির সামনে ব্যাপক বোমাবাজি করানো হয়েছিল। তারপর থেকে নিয়মিত হুমকি, সন্ত্রাস চলছেই।” তারই জেরে ওই সদস্যেরা এখনও পর্যন্ত একটিও সাধারণ সভায় যোগ দিতে পারেননি বলে জানিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে তাঁদের সদস্যপদ থাকা নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছে। তাঁরা বলছেন, “নিয়ম অনুযায়ী পর পর তিনটে সাধারণ সভায় উপস্থিত না থাকলে পঞ্চায়েতের সদস্য পদ থাকা নিয়েই সমস্যা তৈরি হতে পারে। অথচ আইন বাঁচাতে প্রধান আমাদের চিঠি দিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছেন। প্রাণের ভয়ে অফিসে তো ঢুকতেই পারছি না!”
একই দাবি ওই পঞ্চায়েত এলাকা থেকে পঞ্চায়েত সমিতির আসনে জেতা কংগ্রেসের অরুণ চক্রবর্তীরও। তাঁর অভিজ্ঞতা, “মাত্র এক বারই, সেই গত ১৮ সেপ্টেম্বর পঞ্চায়েতের সাধারণ সভায় যোগ দিতে যেতে পেরেছিলাম। কিন্তু সেখান থেকে আমাকে জোর করে বের করে দেওয়া হয়। তৃণমূল মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও বিরোধীদের পঞ্চায়েতে ঢুকতেই না দিয়ে কার্যত গণতন্ত্রকেই হত্যা করছে।” এ দিকে, রোকেয়ারা বলছেন, “ভেবেছিলাম জিতে এলাকার উন্নয়নের জন্য লেগে পড়ব। কিন্তু কোনও কাজেই আমাদের কোনও ভূমিকা নিতে দেওয়া হচ্ছে না। বহু ক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা জেনেও কিছু করতে পারছি না। এই তো, নিধিরামপুর এলাকায় আবুল কালামের নেতৃত্বে পঞ্চায়েতেরই লাগানো গাছ কাউকে না জানিয়ে কেটে বিক্রি করে দেওয়া হল। কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না!”
যাঁর বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, সেই দুবরাজপুর পঞ্চায়ত সমিতির খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ আবুল কালাম অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগই উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর স্পষ্ট দাবি, “কাউকেই বাঁধা দেওয়া হয়নি। আসলে পঞ্চায়েত এলাকায় প্রচুর টাকার উন্নয়নমূলক কাজ চলছে। তা সহ্য করতে না পেরেই বিরোধীরা মিথ্যা প্রচার করছেন।” তাঁর পাল্টা দাবি, উল্টে তাঁকেই খুন করার চক্রান্ত চলছে। এ দিনের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তৃণমূলের ব্লক সভাপতি ভোলানাথ মিত্র। তিনি বলেন, “ওই জয়ী সদস্যদের পঞ্চায়েতে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, এমন খবর আমার কাছে ছিল না। অভিযোগ যখন উঠছে, তখন দলের পক্ষ থেকে বিষয়টি তদন্ত করে অবশ্যই দেখা হবে।” জেলার পুলিশ সুপার সি সুধার বলেন, “বিষয়টির উপরে আমাদের নজরে আছে।” |