জলপাইগুড়ি বিস্ফোরণ কাণ্ডের তদন্তে রাজ্য পুলিশের তৎপরতা বাড়তেই প্রত্যাঘাতের হুমকি দিল কেএলও। পুলিশ-প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের ধারণা, পুলিশি অভিযান রুখতেই গোপন ডেরা থেকে সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের কাছে ফোন করে পশ্চিমবঙ্গে বড় মাপের হামলার হুমকি দিচ্ছে এই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনটি। শহিদ দিবসে কোচবিহার থেকে ‘বাঙালি খেদাবার’ ডাক দিয়ে কেএলও-র সাধারণ সম্পাদক কৈলাশ কোচ এদিন হুমকি দেন, “আমাদের পরিবারের উপরে অন্যায় অত্যাচার চললে, প্রস্তাবিত কামতাপুর এলাকায় পাল্টা আক্রমণ করতে বাধ্য হব।”
গোপন ডেরা থেকে কৈলাশ অবশ্য সেই সঙ্গেই বলেছেন, “পশ্চিমবঙ্গ সরকার আমাদের আলাদা কামতাপুরের দাবি নিয়ে আলোচনা ডাকলে সঙ্গে সঙ্গে যাব।” সেই দাবি উড়িয়ে দিয়ে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব অবশ্য বলেন, “শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনে আগ্রহীদের সব রকম সাহায্য করবেন মুখ্যমন্ত্রী, কিন্তু অশান্তি ছড়িয়ে লুটপাটের ষড়যন্ত্রে যুক্তদের সঙ্গে কোনও কথাবার্তার প্রশ্নই নেই। উত্তরবঙ্গের জনজীবনকে স্বাভাবিক রাখতে সরকার কঠোরতম পদক্ষেপ করবে।” সেই সঙ্গেই তিনি জানিয়েছেন, কেএলও-র হুমকির বিষয়ে সরকার ওয়াকিবহাল। তিনি জানান, পুলিশ-প্রশাসন রাজ্যবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব রকম পদক্ষেপ করছে। উত্তরবঙ্গকে অশান্ত করে উন্নয়ন থমকে দিতে অনেক অশুভ শক্তি সক্রিয়। তিনি বলেন, “কে কাকে কী ভাবে মদত দিচ্ছে, তা নিয়ে তথ্য প্রশাসনের কাছে রয়েছে।”
পশ্চিমবঙ্গে স্বাধীন কামতাপুর গঠনের দাবি ও কোচ-রাজবংশীদের উপরে পুলিশি অত্যাচারের অভিযোগে ১২ জানুয়ারি ভোর ৫টা থেকে ২৪ ঘণ্টার বন্ধ ডেকেছে কেএলও। কৈলাশ ফোনে দাবি করেন, “আমরা নিজভূমে এখন পরবাসী। তাই সশস্ত্র লড়াই ছাড়া কোনও রাস্তা নেই।”
সম্প্রতি জলপাইগুড়িতে ধৃত এক মহিলা জয়মতি রায় ও তাঁর ভগ্নীপতিকে গ্রেফতারের প্রসঙ্গে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন কৈলাশ। তাঁর হুঁশিয়ারি, “আমাদের দলের উপ সেনাধ্যক্ষ তরুণ থাপার বোন চানাচুর বিক্রি করেন। ভগ্নীপতির সঙ্গেও এখন দলের সম্পর্ক নেই। কিন্তু পুলিশ আমাদের সঙ্গে লড়তে না পেরে আমাদের পরিবারের উপরে যে ভাবে অত্যাচার চালাচ্ছে তা মানবাধিকার বিরোধী।”
চাপ বাড়াতে নয়াদিল্লিতেও ধর্না দিয়েছেন অসমের কোচ-রাজবংশীরাও। নয়াদিল্লিতে তাঁরা দাবি করেন, তাঁদের দাবি নিয়ে আলোচনার জন্য উদ্যোগী হোক কেন্দ্র ও রাজ্য। তবে অসমের ১৫টি জেলা ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর আর মালদহকে নিয়ে কামতাপুর রাজ্য গঠনের দাবিতে আন্দোলন চালানো আক্রাসুর সভাপতি বিশ্বজিৎ রায় কেএলও-র লড়াইকে সমর্থন করেননি। তিনি বলেন, “কেএলও যে ভাবে লড়ছে, তা সমর্থন করি না। ওদের ও আমাদের পথ ভিন্ন।” ইতিমধ্যে আলফা সেনাধ্যক্ষ পরেশ বরুয়া বিশ্বজিৎবাবুকে ফোন করে কামতাপুরের লড়াইতে সমর্থন জানিয়েছেন। তবে পরেশবাবুর বক্তব্য, অসম থেকে পৃথক না হয়ে অসম ও বাংলার একাংশ নিয়ে ‘স্বাধীন বৃহত্তর অসম’ গড়া হোক। তবে কেএলও আলফার সঙ্গে আদর্শগত মৈত্রীর কথা বললেও, বৃহত্তর অসমের প্রস্তাব মানতে নারাজ বলে জানিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য কেএলও-র হুমকির বিষয়টি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। জলপাইগুড়িতে বিস্ফোরণের আড়ালে যে কেএলও-র হাত রয়েছে বলে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সন্দেহের কথাও কেন্দ্রকে জানানো হয়েছে। যদিও কৈলাশ ফের দাবি করেছেন, জলপাইগুড়ি বিস্ফোরণ ও অসমের কৃষি বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার গদাপাণি পাঠকের হত্যাকাণ্ড-দুটিতেই, প্রাক্তন কেএলওদের কাজে লাগিয়েছে পুলিশ।
তবে অসম ও পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সন্দেহ, জলপাইগুড়ির বিস্ফোরণ বা তার আগে বড়ভিসা চৌপাটিতে বাসে বিস্ফোরণ, ছাগলিয়ায় গুলিচালনা ও অন্য সব নাশকতার পিছনে মূল মাথা হল কেএলও-র সেনাধ্যক্ষ নিত্য সরকার ওরফে নিত্যানন্দ ওরফে শ্যাম রায় ওরফে দীপক ওরফে জামাই। অসম পুলিশের ডিজি (সিভিল ডিফেন্স ও গৃহরক্ষী) খগেন শর্মা বলেন, “কৈলাশ বা জীবন সিংহ নয়, বড় চিন্তার কারণ নিত্য সরকার। ওই রাজবংশী জঙ্গি অসম-বাংলা সীমানার সব নাশকতার মূল চক্রী।” স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের এডিজি পল্লব ভট্টাচার্যের দাবি, “নিত্য এখন কেএলও-র সেনাধ্যক্ষ। অস্ত্র, প্রশিক্ষণের ব্যাপার সে দেখে।” |