মনোনয়নপত্র পেশের নিয়মবিধি যাতে ঠিকঠাক মেনে চলা হয়, সেটা দেখারই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কিছু শিক্ষককে। দিনশেষে তাঁদের অধিকাংশই অভিযোগ তুললেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের নির্বাচন প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হচ্ছে না। তাঁরা যাতে নিয়ম ভাঙেন, তার জন্য নানা ভাবে শাসানি দেওয়া হয়েছে বলে জানান ওই শিক্ষকেরা। তাঁদের অভিযোগের তর্জনী তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)-এর দিকেই।
এ দিন মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি বিভাগের প্রধান-সহ অন্তত ৮০ জন শিক্ষক। তাঁদের মধ্যে ৫৬ জন সই করে চিঠি লিখে উপাচার্যকে জানান, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন প্রক্রিয়া চলছে না। তাই এর সঙ্গে আর যুক্ত থাকবেন কি না, তা তাঁরা ভেবে দেখবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন কুটা-র নেতারা আজ, বুধবার উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে এই ব্যাপারে আলোচনা করবেন।
নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার, বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষক স্বাগত সেনের বিরুদ্ধেও নিয়ম ভাঙার অভিযোগ এনেছেন ওই শিক্ষকেরা। তা জানিয়ে কর্তৃপক্ষকে একটি পৃথক চিঠি দিয়েছেন তাঁরা। শিক্ষকদের অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন উপাচার্য সুরঞ্জন দাস।
মঙ্গলবার ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রভোটে মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার দিন। শিক্ষকদের অভিযোগ, নানা দিক থেকে চাপ ও শাসানির শিকার হতে হয়েছে তাঁদের। প্রকাশ্যে নাম না-করে ঠারেঠোরে টিএমসিপি-র দিকেই আঙুল তুলেছেন তাঁরা। ওই ছাত্র সংগঠন অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছে। মনোনয়নপত্র নেওয়ার পর্ব যখন প্রায় শেষ, সেই সময় রিটার্নিং অফিসার বেশ কিছু মনোনয়নপত্র একসঙ্গে জমা দেন। বিভাগীয় প্রধানদের বদলে স্বাগতবাবু কেন সেগুলি জমা নিয়েছেন, সেই প্রশ্নও তুলেছেন ওই শিক্ষকেরা।
স্বাগতবাবু অবশ্য জানান, বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার জন্য খুব ভিড় হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কয়েকটি বিভাগের প্রধানেরা তখনও উপস্থিত হননি। তাই অল্প কয়েক জনের মনোনয়নপত্র জমা নিয়েছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ জানান, রিটার্নিং অফিসার হিসেবে এই অধিকার আছে স্বাগতবাবুর।
এ দিন বিশ্ববিদ্যালয়-চত্বরে প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। বন্ধ ছিল পঠনপাঠন ও পরীক্ষা। প্রার্থী হতে আসা ছাত্রছাত্রীদের পরিচয়পত্র ও মনোনয়নপত্র দেখে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয়। নিরাপত্তার খাতিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি ক্যাম্পাস থেকে বাসে শিক্ষকদের আনা হয় কলেজ স্ট্রিটে। তবু এত অভিযোগ কেন?
উপাচার্য বলেন, “সাধারণ নির্বাচনেও তো নানা ধরনের অভিযোগ ওঠে। এখানেও শিক্ষকদের অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে। ওঁরা সকলেই মনোনয়নপত্র জমা নিয়ে খামে ভরে সিল করে দিয়েছেন। পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। তার জন্য ওঁদের ধন্যবাদ। আর এত বিশাল নির্বাচনের প্রক্রিয়া সুষ্ঠু ভাবে শুরু করতে পেরেছি। এই পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয় উত্তীর্ণ।” অনলাইনে মনোনয়নপত্র তোলার বন্দোবস্ত করা গেলেও জমা নেওয়া হয় হাতে হাতে। উপাচার্য জানান, এত মনোনয়নপত্র অনলাইনে জমা নেওয়ার পরিকাঠামো নেই। আগামী বছর সেই চেষ্টা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন কুটা তাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার দাবিতে উপাচার্যকে চিঠি দিয়েছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতেই শিক্ষকদের আনার জন্য বিশেষ বাসের বন্দোবস্ত করা হয়। কিন্তু নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি বলে অভিযোগ জানান কুটা-র সাধারণ সম্পাদক সাংখ্যায়ন চৌধুরী। তিনি বলেন, “এক দল ছাত্র অন্যদের মনোনয়নপত্র না-নেওয়ার জন্য চাপ ও শাসানি দিতে শুরু করে। ক্যাম্পাসে ছাত্রভোট গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হচ্ছে না। মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার দিনেই যদি এমন হয়, তা হলে ভোটের দিনে কী হবে! উপাচার্যকে চিঠি দিয়ে আমরা জানিয়েছি, অপমানিত হওয়ার পরেও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকা সমীচীন কি না, ভেবে দেখতে হবে।” স্বাগতবাবুর বিরুদ্ধেও অভিযোগ জানান তিনি। সাংখ্যায়নবাবু বলেন, “বুধবার উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে গোটা বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করব।”
চাপ ও শাসানির অভিযোগ অস্বীকার করে টিএমসিপি-র রাজ্য সম্পাদক তমোঘ্ন ঘোষ বলেন, “আমরা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সম্মান করি। ওঁদের কোনও রকম চাপ বা শাসানি দেওয়া হয়নি। বরং শারীরবিদ্যার শিক্ষিকা রোশনারা মিশ্র একাই এসএফআইয়ের ১৫০টি মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে গিয়েছেন।”
কুটা জানিয়েছে, এমন কোনও ঘটনার কথা তাদের জানা নেই। রোশনারা বলেন, “আমি নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গেই যুক্ত নই।” ওই শিক্ষিকা বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা, সিপিএমের সূর্যকান্ত মিশ্রের মেয়ে। সেই জন্যই তাঁর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করা হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে। টিএমসিপি-র দাবি, রোশনারাকে গ্রেফতার করতে হবে। স্বাগতবাবু জানান, এই অভিযোগের সমর্থনে সিসিটিভি-র ফুটেজে কোনও প্রমাণ মিললে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হবে।
এ দিন বেলা ১টা নাগাদ কিছু সমর্থক নিয়ে কলেজ স্ট্রিটে হাজির হন টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডা ও তমোঘ্ন। ছাত্র পরিষদের নেতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আশুতোষ চট্টোপাধ্যায় মনোনয়নপত্র দাখিল করতে গেলে তাঁরা বাধা দেন। তাঁদের অভিযোগ, আশুতোষের পরিচয়পত্র ভুয়ো। কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানান, এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
শিয়ালদহ থেকে মিছিল করে কলেজ স্ট্রিটে যাওয়ার কথা ছিল এসএফআইয়ের। কিন্তু তারা তা করেনি। সাধারণ সম্পাদক দেবজ্যোতি দাস বলেন, “আমাদের মিছিলে আক্রমণ হানার জন্য তৃণমূলের সমাজবিরোধী, দুষ্কৃতীরা লাঠিসোঁটা, বোমা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। তাই আমরা কলেজ স্ট্রিট পর্যন্ত মিছিল করিনি।” টিএমসিপি অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
এ দিনের প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরে বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ সাংবাদিক বৈঠকে জানান, ৮৭৬টি পদের জন্য প্রায় ১১০০টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে। কাল, বৃহস্পতিবার বিভিন্ন বিভাগে সেগুলির স্ক্রুটিনি হবে। তার পরে চূড়ান্ত প্রার্থী-তালিকা প্রকাশ করবেন কর্তৃপক্ষ। তার জন্য সব ক্যাম্পাসে পুলিশি প্রহরা থাকবে বলে উপাচার্য জানান। রেজিস্ট্রার বাসব চৌধুরী জানান, স্বচ্ছতার খাতিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটেও প্রার্থী-তালিকা প্রকাশ করা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সোমবার এক ছাত্র কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন। মঙ্গলবার আদালত তা খারিজ করে দিয়েছে বলে জানান সুরঞ্জনবাবু। |