ময়না-তদন্তের পরে বৃদ্ধা প্রভাদেবী, মাঝ বয়সী বিজয়াদেবী ও তাঁর তরুণী কন্যা আত্রেয়ীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁদের ফ্ল্যাটে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বহরমপুরের কাদাই অঞ্চলের আশাবরী আবাসন থেকে শববাহী গাড়িতে তাঁদের বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দীর্ঘ নয় বছরের সম্পর্ক চিরদিনের মতো ছিন্ন হয়ে গেল। তার আগে শেষ বারের মতো চোখের দেখা দেখতে এদিন সন্ধ্যা নামতেই ওই আবাসন চত্বরে ভিড় করেন পাড়া-প্রতিবেশীরা। সোমবার সন্ধ্যায় ওই আবাসনের ‘ডি’ ব্লকের নীচের তলার এক কামরা ফ্ল্যাটের তালা ভেঙে ওই তিন মহিলার মৃতদেহ উদ্ধার করে বহরমপুর থানার পুলিশ। এ দিন ওই তিন মহিলাকে চোখের জলে বিদায় দিলেন প্রতিবেশীরা।
এ দিন দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী আত্রেয়ীর স্মরণে বানজেটিয়া এলাকায় প্রভারানি পাবলিক স্কুল বন্ধ ছিল। ওই স্কুলেই পড়ত উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী বিজ্ঞানের ছাত্রী আত্রেয়ী। তার মৃত্যুর খবর পেয়ে হতবাক হয়ে যান স্কুলের সহপাঠী থেকে শিক্ষক-শিক্ষিকারা। স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, আত্রেয়ী পড়াশোনায় যেমন ভাল ছিল, তেমনই নাচেও দক্ষ ছিল। ফলে স্কুলের কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলে তাতে ওই ছাত্রী কোনও না কোনও ভাবে জড়িত থাকত। তাকে ছাড়া স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত না। ফলে ওই ছাত্রীর টানেই শিক্ষিকা দীপশিখা রায়চৌধুরী বহরমপুরের মর্গেও হাজির হন। তিনি পৌঁছানোর আগেই সেখানে হাজির ছিলেন আত্রেয়ীর সহপাঠীরা। আত্রেয়ীর এ ভাবে চলে যাওয়া কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছে না শাশ্বত সাহা, দেবানিক ভট্টাচার্য, দীপ মণ্ডল, ওয়াসিম হোসেনদের মতো তার সহপাঠীরা। ময়নাতদন্তের পরে তাঁরা আত্রেয়ীয়ের দেহ কাঁধে করে নিয়ে এসে শববাহী গাড়িতে তোলেন। রজনীগন্ধা ও গাঁদা ফুল দিয়ে নিজেদের হাতে সাজিয়েও দেন তাঁরা। কেউ কেউ কান্নায়ও ভেঙে পড়েন। |
পরে সন্ধ্যায় আবাসনে ভিড় করেন স্কুলের শিক্ষিকারা। আত্রেয়ীকে দেখে তাঁরাও কান্না ধরে রাখতে পারেননি। দীপশিখাদেবী বলেন, “তৃতীয় শ্রেণি থেকে আত্রেয়ীকে দেখছি। পড়াশোনায় যেমন ভাল ছিল, তেমনই ভাল নাচতেও পারত মেয়েটি। ওকে ছাড়া স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কথা ভাবাই যেত না।”
এদিকে ওই তিন মহিলার খুনিদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবিতে শহরে মিছিল করে কংগ্রেস, তৃণমূল এবং সিপিএম। এদিন বিকেলে মণীন্দ্রচন্দ্র বিদ্যাপীঠ স্কুল ময়দান থেকে শুরু হয় কংগ্রেসের মিছিল। মিছিলের সামনের সারিতে ছিলেন রেল দফতরের প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী। অন্য দিকে, এদিন দুপুরে তৃণমূলের মিছিলের পরে বিকেলের দিকে মর্গে যান বহরমপুরের বিরোধী দলনেতা তৃণমূলের প্রদীপ নন্দী ও কাউন্সিলর তৃণমূলের কানাই রায়।
ওই ঘটনার পর থেকে পাড়ায় শোকের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। মঙ্গলবার বহরমপুরের সমস্ত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আবাসন চত্বরের দোকানপাটও বন্ধ ছিল। ফলে এদিন সকাল থেকেই পাড়া জুড়ে নীরবতা ছেয়ে রয়েছে। আবাসিক সোনালী ঘোষাল বলেন, “বুকের ভেতরে দমবন্ধ করা অবস্থা। জানালা খুলে তাকালেই ফুলের মতো নিষ্পাপ মেয়েটিকে দেখতে আর পাব না, তা ভাবতেই পারছি না। রান্না-খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রান্নাঘরের দিকে যেতেই ইচ্ছে করছে না। মন খারাপ নিয়ে ঘরের মধ্যেই বসে রয়েছি। শুধু ভাবছি, হয়তো আত্রেয়ীয়ের জন্য এই মৃত্যু কাম্য ছিল না।” প্রতিবেশী অরুণিমা রায় বলেন, “আমার পাঁচ বছরের মেয়ের সঙ্গে আত্রেয়ীয়ের খুনসুটির সম্পর্ক ছিল। মেয়ের শরীরে জ্বর ছিল। ওই ঘটনা জানার পরেই মেয়ে আরও বেশি করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমিও সোমবার রাতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি। ঘুম ভাঙতেই কচি মুখটা ভেসে উঠছে বারবার। এদিন খাওয়া-দাওয়াও করতে পারিনি। সব সময়ে মাথা ঘুরছে বলে মনে হচ্ছে।”
সোমবার মৃতদেহ উদ্ধারের পর থেকে আবাসনে ওই ফ্ল্যাটের সামনে পুলিশ মোতায়েন ছিল। এদিন দুপুর ও বিকেলে দু’দফায় ওই ফ্ল্যাটে তদন্তে যান মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর। পুলিশ বেশ কয়েক জনকে থানায় ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে। কিন্তু সন্দেহজনক কিছু তাদের কাছ থেকে পায়নি। ফলে তাদের ছেড়েও দেয়। পুলিশ প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই খুনের কিনারা করতে পুলিশের সমস্ত ‘সিনিয়র’ ও ‘দক্ষ’ অফিসারদের কাজে লাগানো হয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত ওই ঘটনার কোনও রহস্যভেদ হয়নি। কিন্তু পাড়া-প্রতিবেশী থেকে সকলেই চানপুলিশ দ্রুত ওই খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করুক এবং ধরা পড়ুক প্রকৃত খুনি! |