গ্রামাঞ্চলে বিনামূল্যে ঔষধ এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার যে সিদ্ধান্ত মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করিলেন, তাহা বহু স্তরে আপত্তিকর। প্রথমত, পশ্চিমবঙ্গের ভঙ্গুর স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিকাঠামো এই সিদ্ধান্তের ভার সহিতে পারিবে না। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কথা উহ্যই থাকুক, ব্লক স্তরেও বহুবিধ জীবনদায়ী ঔষধ প্রায় সর্বদাই অমিল। বিনামূল্যে ঔষধের ব্যবস্থা হইলে নিঃসন্দেহে চাহিদা বাড়িবে। জোগান বাড়াইবার কোনও তুল্য ব্যবস্থার কথা যখন রাজ্য প্রশাসন উল্লেখ করে নাই, তখন ব্যবস্থা হইতেছে না বলিয়াই ধরিয়া লওয়া যায়। ব্লক স্তরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও বহু পরীক্ষার ব্যবস্থা নাই। অদূর ভবিষ্যতে হইবে, তেমন সম্ভাবনাও নাই। বাস্তবে যে পরিষেবা দেওয়া নিতান্তই অসম্ভব, তাহার প্রতিশ্রুতি দেওয়া কেন? সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার উপর মানুষের এমনিতেই বিশেষ ভরসা নাই। এমন অবাস্তব প্রতিশ্রুতির ফলে সেইটুকুও থাকিবে না বলিয়াই আশঙ্কা।
কিন্তু, এই আপত্তিটি তুলনায় গৌণ। রাজ্য প্রশাসন কোনও জাদুমন্ত্রে রাতারাতি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর আমূল সংস্কার করিয়া ফেলিলে আর আপত্তিটি থাকিবে না। কিন্তু, কোনও জাদুমন্ত্রেই যে সমস্যার গতি হইবে না, তাহার নাম শূন্য রাজকোষ। রাজ্য কোষাগারের হাঁড়ির হালের কথা মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই ভুলেন নাই। সেই রাজকোষ এই নূতন খয়রাতির ভার কী ভাবে বহন করিবে? শূন্য রাজকোষের উপর মুখ্যমন্ত্রীর বদান্যতার ভার অবশ্য এখনও নেহাত কম নহে। ইমামদের মাসিক ভাতা হইতে ভুয়া আর্থিক সংস্থার হাতে প্রতারিত মানুষের ক্ষতিপূরণ, বেকারদের মাসোহারা হইতে ক্লাবে-ক্লাবে অনুদান, সবই ওই রাজকোষ হইতেই চলিতেছে। ইহার উপর বিনামূল্যে ঔষধের ভার চাপিলে টাকা জোগাইবেন কোন গৌরী সেন? মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য একটি কাজ করিতে পারেন— এ যাবৎ কাল যত খয়রাতি হইয়াছে, সমস্ত বন্ধ করিয়া দিন। একেবারে গোড়া হইতে ভাবিতে আরম্ভ করুন কোন কাজটি জরুরি আর কোনটি নহে। সেই তুল্যমূল্য বিচারে যদি ক্লাবগুলিকে অনুদান দেওয়া অপেক্ষা গ্রামাঞ্চলে নিখরচায় ঔষধ দেওয়া অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বলিয়া বিবেচিত হয়, তবে সেই কাজটি করুন। একই সঙ্গে সব খয়রাতির ভার পশ্চিমবঙ্গ বহিতে পারিবে না। মুখ্যমন্ত্রীকে আরও একটি কথা স্মরণ করাইয়া দেওয়া যাউক। রাজস্থানে নিখরচায় ঔষধ বিলাইয়াও কিন্তু অশোক গহলৌত ভোটে জিতিতে পারেন নাই। কেবল খয়রাতি নহে, প্রকৃত উন্নয়ন হইতেছে কি না, মানুষ সেই খবরও রাখে।
তৃতীয় আপত্তি ঔচিত্যের। পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক সংকট যদি এমন তীব্র না হইত, যদি দিল্লি সরকারের ন্যায় পশ্চিমবঙ্গের হাতেও অঢেল টাকা থাকিত, তবুও কি এমন পাইকারি বদান্যতা উচিত হইত? উত্তর নেতিবাচক। দরিদ্র মানুষের উন্নয়নকে সরকার আপন কর্তব্য মনে করিতে পারে। স্বাস্থ্য পরিষেবা তাহার একটি জরুরি অংশও বটে। কিন্তু মধ্যবিত্ত বা ধনীর জন্য নিখরচায় ঔষধের ব্যবস্থা করা সরকারের কাজ হইতে পারে না। মুখ্যমন্ত্রীর বর্তমান সিদ্ধান্তে ধনী-দরিদ্র ভেদ নাই। গ্রামাঞ্চলে সকলেই এই খয়রাতির হকদার। এই ব্যবস্থায় শেষ পর্যন্ত (ক্ষমতাহীন) গরিবরা বাদ পড়িবেন— সুবিধার সিংহভাগ মধ্যবিত্ত বা ধনীর হাতে যাইবে। সরকার গরিব মানুষের জন্য উন্নততর স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থা করিতে চাহিলে তাহা প্রত্যক্ষ ভর্তুকির মাধ্যমে করুক, এমন পাইকারি ভঙ্গিতে নহে। অবশ্য তাহাতে ভোটের বাজারে যথেষ্ট লাভ না হইবার আশঙ্কা থাকিয়া যায়। |