|
|
|
|
সাক্ষাৎকার... |
বামপন্থীরা যে কণ্ঠহীন হয়ে পড়ছেন, সেটা দেশের পক্ষে শুভ নয়
দেশের মানুষ অনাহারে পীড়িত, খাদ্যাভাবে তাঁদের মেধা স্তিমিত, অসুখে ভোগার এবং মৃত্যুর
সম্ভাবনা
বেড়ে
যাচ্ছে, লেখাপড়ার মান প্রায় সব দেশের তুলনায় নীচে, এ সব নিয়ে বামপন্থীদের চিন্তার বড় রকম
পরিচয়
পাচ্ছি না। এর মধ্যে একটা চিন্তার খেলাপ আছে। অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়কে সাক্ষাৎকারে বললেন অমর্ত্য সেন |
বামপন্থীরা পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন তাঁদের যা যা করার কথা ছিল তার বিশেষ কিছুই করতে পারেননি। আপনি এবং জ্যঁ দ্রেজ বলেছিলেন, বামপন্থী শাসিত পশ্চিমবঙ্গে অনেক সুযোগ নষ্ট হয়েছে। আজ তাঁরা ক্ষমতার বাইরে, এবং ধূলিসাৎ হয়ে গেছেন, এখনও কিছুই করে বা ভেবে উঠতে পারছেন না। তাঁদের সমস্যাটা ঠিক কোথায়?
এটা আমার কাছে খুব আশ্চর্যের এবং খুব দুঃখের বলেই মনে হয়, যেহেতু আমার নিজের রাজনৈতিক সহানুভূতি বামপন্থার দিকেই। তবে এটা শুধু পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা বলে ধরলে চলবে না। সমস্ত দেশ জুড়েই বামপন্থী রাজনৈতিক চিন্তার মানের একটা প্রচণ্ড অবনতি ঘটেছে বলে আমি মনে করি। সেটা আমার দুঃখের কারণ, কেননা এটা না হলে যে ভারতবর্ষ হতে পারত সেই ভারতবর্ষ বিষয়ে আমার খুব আশা ছিল। এখানে দুটো জিনিস বলা যায়। একটা হচ্ছে, বামপন্থা এবং দক্ষিণপন্থা, দুটোই আমাদের দেশের সাবেকি ধর্মভিত্তিক এবং সাম্প্রদায়িক চিন্তার থেকে বাইরে। দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক পথ হোক, বামপন্থী রাজনৈতিক পথ হোক, সাম্প্রদায়িক চিন্তামুক্ত রাজনীতির একটা প্রয়োজন আছে। তার জন্যেই, স্বতন্ত্র পার্টি যখন ধূলিসাৎ হয়ে গেল তাতেও আমি দুঃখ বোধ করেছিলাম, এই জন্যে যে, সাম্প্রদায়িকতা বাদ দিয়ে দক্ষিণপন্থার চিন্তাটা কী, বামপন্থার সঙ্গে তার কী তফাত, এ নিয়ে তো আমাদের চিন্তা করার প্রয়োজন আছে।
এবং দক্ষিণপন্থীরা যে কথাগুলো বলেন, তার মধ্যেও তো কিছু কিছু চিন্তনীয় মূল্যবান জিনিস আছে। যেমন, বাজারের ভূমিকা কী, ইনসেনটিভটা কী করে দিতে হয়, কেন এ-রকম দাঁড়ায় যে সরকারি জায়গাগুলোতে ইনসেনটিভের যে অভাব হচ্ছে, অনেক সময়— সব সময় না হলেও— বেসরকারি হাতে দিলে সেই সমস্যা হয় না। এই বিষয়ে দক্ষিণপন্থীদের একটা বক্তব্য আছে, তার সঙ্গে তো হিন্দুত্বের কোনও যোগ নেই। তাই স্বতন্ত্র পার্টি যখন শেষ হয়ে গেল, তখন আমি সে বিষয়ে আলোচনা করেছিলাম এবং সেটা দুঃখজনক ঘটনা বলেছিলাম। যদিও আমাকে এটাও বলতে হয়েছিল যে, আমি স্বতন্ত্র পার্টিকে কোনও দিনই ভোট দিতাম না, তবু ভারতবর্ষের রাজনৈতিক চিন্তার দিক দিয়ে স্বতন্ত্র পার্টির থাকাটা আমার একটা শুভ জিনিস বলে মনে হয়েছিল। ঠিক তেমনই, বামপন্থার দিক দিয়ে রাজনৈতিক চিন্তার প্রয়োজনটা ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টি মেটাতে পারতেন। কিন্তু বামপন্থা যদি ধূলিসাৎ হয়ে যায়, তা হলে সেই সুযোগটাও চলে যাবে। বলতেই হবে যে, এটা একটা দুঃখের কারণ।
আর একটা দুঃখের কারণ হল, বামপন্থা এবং দক্ষিণপন্থার মধ্যে, ইংরেজিতে যাকে বলে নিউট্রাল, তা তো আমি নই। আমার ধারণা, বামপন্থার যে বক্তব্যগুলো আছে, সব মিলিয়ে ভারতবর্ষের পক্ষে সেগুলো অনেক বেশি ন্যায্য। অতএব সে দিক থেকে দেখলে, এই সময় যে বামপন্থীদের একটা কণ্ঠহীনতা তৈরি হল, সেটা দেশের পক্ষে ক্ষতিকর বলে আমি মনে করি। কারণ এখানে এখন এক দিকে কংগ্রেস সম্বন্ধে সবাই মনে করছেন যে তাঁদের কিছু করার ক্ষমতা নেই, তাঁদের ইনকমপিটেন্স অনেক, দুর্নীতি বন্ধ করার ব্যাপারে তাঁরা গভীর চিন্তা করেছেন এটা মনে করারও খুব একটা কারণ নেই। উল্টো দিকে, যাঁরা কংগ্রেসের বহুমুখী আর্থিক নীতির বিরোধী, এবং একমাত্র আয়বৃদ্ধির দিকেই বিশেষ জোর দিচ্ছেন, সেই বাজারপন্থীদের হিন্দুত্ব এবং আর এস এস-এর ওপর নির্ভর করার কোনও বড় কারণ নেই। তাঁরা যে সে পথেই যাচ্ছেন, তার কি সত্যিই কোনও প্রয়োজন ছিল?
অন্য দিকে, বামপন্থীরা তো জোরদার ভাবে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী। তাঁদের গলার জোর থাকলে নানা বড় সমস্যা আলোচিত হতে পারত, এখন যেখানে ঘাটতি পড়েছে। রাজনৈতিক অর্থনৈতিক চিন্তা, সরকারি কাজকর্ম কী উপায়ে ঠিক ভাবে, ভাল করে চলতে পারে, এবং দেশে যাঁরা কোনও রকম অর্থনৈতিক প্রগতির সুযোগ পান না, কী ভাবে তাঁদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যের প্রসার করা যেতে পারে, কী ভাবে তাঁদের অর্থনৈতিক জোর বাড়ানো যেতে পারে, এই আলোচনাগুলো তো বামপন্থীদেরই করা উচিত। সাম্প্রদায়িকতা বর্জিত দক্ষিণপন্থার প্রয়োজন স্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মানতে হবে যে, বামপন্থী চিন্তার আরও বড় প্রয়োজন। বামপন্থা ধূলিসাৎ হলে দেশের খুবই লোকসান।
অবশ্য ‘ধূলিসাৎ’ কথাটা হয়তো পুরো ঠিক নয়। বামপন্থীরা দুর্বল হয়েছেন নিশ্চয়ই, কিন্তু এটাও দেখা যাচ্ছে যে, সি পি এমের সভায় লোক আসছেন, বিহারে সি পি আইয়ের খুব বড় বড় মিটিং হচ্ছে, লিবারেশন পঞ্চাশ হাজার লোকের মিটিং করেছে...
না, কিন্তু এক সময় যাঁদের একেবারে মুঘল সম্রাটের মতো প্রতিপত্তি ছিল, তাঁদের একটু ক্ষমতা কমে যাওয়াটাই ধূলিসাৎ হওয়ার মতো দেখাবে, ধূলিসাৎ হওয়ার জন্য একেবারে ধূলির সঙ্গে মিশে যাওয়ার তো প্রয়োজন নেই! বামপন্থীরা অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছেন, এটাই বোধহয় এখানে বলার কথা। এখন, প্রশ্নটার দুটো দিক ছিল। এক হল, এটা কতটা সংকট, এবং তার কুফলগুলি কী। তারই জবাব দিচ্ছিলাম। তার সঙ্গে আর একটা প্রশ্ন, কেন ঘটল এই সংকট? সেটা নিয়ে কিছু আলোচনা করা যেতে পারে। কী মনে করো তুমি?
ঠিক বুঝতে পারি না, তবে একটা কথা মনে হয়। আমাদের দেশে নিশ্চয়ই এখনও বহু মানুষ আছেন, যাঁদের কাছে বামপন্থা খুবই প্রাসঙ্গিক, তাঁদের জীবনের সমস্যাগুলো তো কোনও এক ভাবে বামপন্থাতেই সমাধানের চেষ্টা করতে হবে বলে তাঁরা মনে করেন। কিন্তু বামপন্থী দলগুলো যাঁরা চালান, তাঁদের সঙ্গে এই সব মানুষের কতটা সংযোগ আছে? এখানেই একটা প্রশ্ন মনে আসে। পশ্চিমবঙ্গে অন্তত বামপন্থী দলের নেতৃত্ব প্রায় পুরোপুরি উচ্চবর্গের হাতে থেকে গেছে, সেটাই কি তাঁদের দুর্বলতার বড় কারণ?
এখানে তিনটে সমস্যা আছে।
প্রথম হচ্ছে, বামপন্থী নেতৃত্বের, যাকে বলা চলে, শ্রেণিক্ষীণতা। এটা ঠিকই যে, বামপন্থী নেতৃত্বের মধ্যে উচ্চবর্গের প্রাধান্য এখনও খুবই বেশি রকম। অবশ্য উচ্চ শ্রেণি থেকে বড় ও ভাল চিন্তা আসতে পারে না এমন কথা মনে করার কোনও কারণ নেই। কার্ল মার্ক্স থেকে গ্রামশি ও রজনী পাম দত্ত, সবাই তো উচ্চ শ্রেণি থেকেই এসেছেন, তাতে করে যে সৎ চিন্তার খেলাপ ঘটেছে, এটা মনে করার সত্যিই কোনও কারণ নেই। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কোন দিকে কষ্ট পাচ্ছেন, কোন দিকে তাঁদের উন্নতির প্রয়োজন, কোন দিকে নজর দেওয়ার জন্য তাঁরা প্রশ্ন করছেন এবং নিজেরাও খানিকটা জবাব দিচ্ছেন, এই সব বিষয়ে শ্রেণিক্ষীণতা থেকে যে রাজনৈতিক দুর্বলতা আসে তা তো উপেক্ষণীয় নয়। |
|
দ্বিতীয় কথা, এবং এটা আমি খুবই বড় বলে মনে করি, আমাদের বামপন্থার চিন্তাধারা তো গোড়ায় বিদেশ থেকে এসেছিল। প্রথম দিকে ভারতবর্ষেও নতুন বামপন্থী চিন্তার অভাব ছিল না, কিন্তু বিদেশি মূলটি শক্ত ছিল। সেই বিদেশমুখী বা বিদেশভিত্তিক দর্শন আমাদের দেশে নতুন চিন্তার বিরোধী হয়েই থেকে গেছে। সেটার তো কোনও পরিবর্তন হয়নি। অথচ এক দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন উঠে গেল, অন্য দিকে চিনে কমিউনিস্ট পার্টি যে বাজারধর্মী অর্থনীতি করছেন, এ বিষয়ে তো কোনও সন্দেহ নেই। আমরা কিন্তু এখনও ওই আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ বলে একটা টার্গেট খাড়া করে তার সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছি, সেই লড়াইকেই প্রাধান্য দিয়ে চলেছি। বাস্তবতার সঙ্গে একটা বড় রকমের ফারাক দেখা দিয়েছে। সেটা ক্রমশই বাড়ছে।
যে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল, তার সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে আমেরিকার ঝগড়া ছিল, তখন এর একটা বড় মানে ছিল। এখন চিনের সঙ্গে আমেরিকার একটা বচসা আছে, কিন্তু সেটা রাজনীতির কারণে নয়, সেটা তো আন্তর্জাতিক বাজারে অর্থনৈতিক প্রাধান্য কার হবে, তা নিয়ে। বলা যেতে পারে, এটা একেবারেই ধনতান্ত্রিক সমাজের একটা বিশেষ রূপ, যে— অর্থনৈতিক ক্ষমতা কার বেশি হবে। এরই মধ্যে আমরা আন্তর্জাতিক বাস্তবতা উপেক্ষা করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি। কুলীন ব্রাহ্মণ রূপে পুরনো আচারবিচার মেনেই আমরা সাবেকি ক্রিয়াকর্মগুলি করে যাচ্ছি। আমেরিকার যে সাম্রাজ্যপ্রীতি নেই তা নয়, এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাদের গায়ের জোরও অনেক, নানা ভাবে পৃথিবীতে তার প্রকাশ হয়। কিন্তু এটাই আমাদের প্রধান সমস্যা নয়, এবং এর সঙ্গে লড়াই করতে হলে পঞ্জিকা অনুসরণ করে পুরোটা পথ চলতে থাকার খুব কারণও আমাদের নেই।
কংগ্রেস সরকার যখন আমেরিকার সঙ্গে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে চুক্তি করলেন, তখন তো কমিউনিস্ট পার্টি থেকে সরকারের সমর্থন তুলে নিয়ে সরকার ফেলে দিতে চেষ্টা করা হল। তাঁরা যদি তখন সে চেষ্টায় সফল হতেন, তা হলে বোধহয় পার্টি আরও হীনবল হয়ে যেত। সে পতন না হলেও কমিউনিস্ট পার্টির তখন তেজ কমে গেল। অথচ সেই সময় এ-রকম করার তেমন কোনও কারণ ছিল না। প্রথম কথা, কমিউনিস্ট পার্টি দুটি তো সরকারে ছিলেন না, বাইরে থেকে তাকে টিকতে দিচ্ছিলেন। তাঁরা যদি বলতেন, এই নীতিতে আমরা বিশ্বাসী নই, কিন্তু এই কারণে আমরা সরকারকে ফেলব না, সবাই সেই যুক্তিটা বুঝতে পারতেন। রাজনৈতিক চিন্তা করতে পারে এ-রকম যে কোনও লোকেরই এই ব্যাপারটা ভাবা উচিত, অথচ তখন তাঁরা ওই দিকটিকে উপেক্ষা করলেন। আমি নিজেও তো মনে করি, আমাদের দেশে যে পারমাণবিক শক্তি তৈরি হচ্ছে, তাতে আমাদের লাভের চেয়ে ক্ষতি অনেক বেশি। ফুকুশিমার মতো দুর্ঘটনার সম্ভাবনা আছে, অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা আছে, মুম্বইয়ের হোটেলে যা হয়েছিল, একটা পারমাণবিক কেন্দ্রে যদি তা হত, তার ভয়াবহ পরিণাম হতে পারত। তার ওপর নিউক্লিয়ার মেটিরিয়াল চুরি যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে, এবং তার ফলে সন্ত্রাসবাদীদের হাতে বড় অস্ত্র আসতে পারে। এ-সব কারণেই আমিও এর বিরোধী। কিন্তু তাই বলে সরকারের পতন ঘটানোর তখন কোনও কারণ ছিল না। সেই সময় সরকারের পতন হলে বিজেপি ক্ষমতায় আসত। সেই সম্ভাবনা যে তখন ঠেকানো গিয়েছিল, সেটা যে কমিউনিস্ট পার্টির জন্যে ঠেকানো গিয়েছিল, তা তো বলা যাবে না।
তৃতীয়ত, কমিউনিস্ট পার্টির কাছে তো বিভিন্ন বিষয়ে নতুন চিন্তার একটা আশা করা যায়। যেমন, অর্থনৈতিক বাস্তব নিয়ে নতুন ভাবে চিন্তা করা দরকার। বাজার ব্যবস্থার প্রয়োগে লোকের অর্থনৈতিক উন্নতি কতটা করা সম্ভব, এটা একটা বড় প্রশ্ন। সেটা বিভিন্ন দেশের নিজের অর্থনীতির উন্নয়নের পক্ষে কাজে লাগতে পারে। চিনে এর প্রয়োগ প্রচণ্ড বেশি, কিন্তু চিন বাদ দিলেও অন্যান্য দেশেও এটা খুবই দেখা যাচ্ছে, যেমন ভিয়েতনাম। এ সব বিষয়ে নতুন চিন্তার প্রয়োজন। তার পাশাপাশি সরকারের কী করা উচিত, কী ভাবে করা উচিত, সে-সব বিষয়েও বামপন্থীদের সুস্পষ্ট ও সাবলীল চিন্তা আশা করা যায়। আমেরিকার সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে তাঁরা অত্যন্ত চিন্তিত, কিন্তু দেশের
মানুষ অনাহারে পীড়িত, খাদ্যাভাবে তাঁদের মস্তিষ্ক এবং মেধা স্তিমিত থাকছে, অসুখে ভোগার এবং মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে, লেখাপড়ার মান পৃথিবীর প্রায় সব দেশের তুলনায় নীচে— এ সব নিয়ে বামপন্থীদের চিন্তার বড় রকম পরিচয় পাচ্ছি না, কেবল ওই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে কী ভাবে রোখা যায়, তাই নিয়ে আলোচনা। বলতেই হবে, এর মধ্যে একটা চিন্তার খেলাপ আছে। ভারতবর্ষের পক্ষে তার ফল ভাল বলে আমি মনে করি না।
সুতরাং এই তিনটি ক্ষীণতাকে আমি সমস্যা বলে মনে করি।
প্রথমত, নতুন চিন্তা খুব একটা কিছু হচ্ছে না;
দ্বিতীয়ত, বহির্মুখী চিন্তার দিকে আমাদের নজর, এবং তা-ও পাঁজি দেখে পুরনো পথে;
তৃতীয়ত, শ্রেণি-বিভাগের দিক থেকে আমাদের বামপন্থী নেতৃত্ব এখনও খুবই উচ্চবর্ণ নিয়ন্ত্রিত। এ-সব ক’টাই বেশ খানিকটা চিন্তার কারণ।
এই বহির্মুখী চিন্তার কথাটার সূত্র ধরে একটা কথা বলি। বিভিন্ন দেশে বামপন্থী চিন্তায় তো অনেক পরিবর্তন এসেছে। ইউরোপে, লাতিন আমেরিকায় বামপন্থী দলগুলো নিজেদের অনেক ভাবে পালটেছে। বহির্মুখী চিন্তায় অভ্যস্ত দল বা তার নেতারা সে-সব অভিজ্ঞতা থেকেও অনেক কিছু শিখতে পারতেন। সেগুলোও তো বাইরের অভিজ্ঞতা।
ঠিকই। বহির্মুখী আগ্রহে আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু বহির্মুখী বিভ্রান্ত চিন্তাকে প্রাধান্য দেওয়াতে আমার আপত্তি না করে কোনও উপায় নেই। সারা পৃথিবী থেকেই অনেক কিছু শেখা যায়। যে কথাটা আমি নানা ভাবে বলার চেষ্টা করি আমাদের চিন থেকে শেখার অনেক কিছু আছে, জাপান থেকে শেখার আছে, কোরিয়া থেকে শেখার আছে, ইউরোপ থেকে শেখার আছে, ইত্যাদি। কিন্তু ওঁরা তো ঠিক তা করেননি। এক সময় ছিল কমিনটার্ন— তাঁরা যা ঠিক করলেন, সেই মতোই ওঁরা ভাবতেন। অর্থাৎ এই বহির্মুখী চিন্তার মধ্যে বিশেষ কিছু নির্দিষ্ট যুক্তিধারার প্রাধান্য ছিল। এখানে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, মজার ব্যাপারও বলা যেতে পারে, যে, যাঁদের কাছ থেকে সেই নেতৃত্ব আসত তাঁরা তো সরে গেছেন, নেই কেউ, কিন্তু সেই একই ধরনের পুরনো চিন্তার প্রাধান্যটা থেকে গেছে।
রবীন্দ্রনাথের লেখায় আছে ‘কর্তার ভূত’-এর কথা, কর্তা চলে গেছেন কিন্তু ভূত আছে। এটা একেবারেই সেই কর্তার ভূতের ব্যাপার। কর্তা নেই, রাশিয়ায় তো নেইই, চিনে এক ভাবে আছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের চিন্তাধারা তো একেবারেই অন্য দিকে, অথচ ভূতরা থেকে গেছে। এবং রবীন্দ্রনাথের লেখাতেই আছে, কর্তা থাকলে তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করা যায়, ভূতের সঙ্গে যুক্তিতর্ক করা অনেক কঠিন।
এখানে একটা প্রশ্ন। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাটা খুব জরুরি। কিন্তু সেই যুদ্ধটা করবার জন্য একটা ওয়াকিবহাল, সক্ষম জনসাধারণকে তো চাই, যাঁরা শিক্ষায় স্বাস্থ্যে সমৃদ্ধ, যাঁরা জানেন কী ঘটছে না ঘটছে। কংগ্রেস বা বিজেপির রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়তে হলেও তো এগুলোয় জোর দেওয়া জরুরি। এটা কেন বুঝে ওঠা গেল না, সেটা আশ্চর্যের ব্যাপার নয় কি? অথচ কেরলে কিন্তু বামপন্থীরা অন্য ভাবে চিন্তা করেছেন।
কেরালায় করেছেন। সেখানে বামপন্থীদের চিন্তাটা শুধু বহির্মুখী চিন্তা নয়। এবং সেটাই তো কেরালার মাধুর্য। সেখানে কমিউনিস্ট পার্টি এল উচ্চবর্ণের আধিপত্য বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। তাদের একটা নিজেদের দর্শন ছিল। তার মধ্যে একটা হচ্ছে যে, যতটা সম্ভব অনৈক্য দূর করার চেষ্টা করতে হবে, এবং তার একটা উপায় হচ্ছে সবার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা। সবাই শিক্ষার সুযোগ পেলে তাঁরা স্বাস্থ্য চাইবেন, রাজনৈতিক পরিবর্তন চাইবেন এবং পরিবর্তন কী রূপে চাইবেন সে বিষয়ে তাঁদের খুব স্পষ্ট বক্তব্য থাকবে। কমিউনিস্ট পার্টি এই জিনিসটা তো ওই উচ্চবর্ণবাদ-বিরোধী আন্দোলন থেকে পেল। কেরালার পার্টি কখনওই সম্পূর্ণ ভাবে বহির্মুখী হয়নি, তাঁরা একটা দেশি সমস্যার সমাধান করার জন্যই চেষ্টা করেছেন, আলোচনা করেছেন।
কেরলে মন্দিরে নিম্নবর্ণের প্রবেশের অধিকার নিয়ে আন্দোলনেও বামপন্থীরা সংযুক্ত হয়েছেন, যেটা এখানে ভাবা কঠিন। বস্তুত, এখন ভারতবর্ষে তো অনেক রকম আন্দোলন হচ্ছে। অনেক ধরনের অধিকারের জন্য...
খাবারের অধিকার, তথ্য জানার অধিকার...
জমির অধিকারের জন্যে, আদিবাসীদের অধিকারের জন্যে... কিন্তু বামপন্থী দলগুলো অনেক সময়েই নিজেদের এগুলো থেকে দূরে রাখে। অথচ এই সব আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের সংযুক্ত না করলে তো হবে না।
ঠিকই। এবং সেটা কী কারণে ঘটছে না, তা বোঝা দরকার। বলা যায়, চিন্তার অভাব, কিন্তু তা বললে দুটো অসুবিধে আছে। এক, তাতে খুব ব্যাখ্যা হল না— কেন চিন্তার অভাব, সেই প্রশ্নটা থেকেই গেল। আর দ্বিতীয়ত, এ কথা বলে বোধহয় একটু দাম্ভিকতাও দেখানো হল। কিন্তু তবু, এটা যে চিন্তার বিভ্রান্তি, তা না বলে কোনও উপায়ও নেই।
অশোক রুদ্র যে ‘ইনটেলিজেনসিয়া অ্যাজ রুলিং ক্লাস’-এর ধারণাটা এনেছিলেন, এটা কি তার সঙ্গে কোনও ভাবে যুক্ত?
খানিকটা যুক্ত হচ্ছে বটে, সেটা একটা ব্যাপার তো নিশ্চয়ই। কিন্তু আর একটা ব্যাপার হচ্ছে, দেশের প্রধান পার্থক্য হল গরিব এবং বড়লোক, অবস্থাপন্ন এবং অবস্থাহীন, ক্ষমতাশীল এবং ক্ষমতাহীন... এই সব কটা বর্গের মধ্যে যখন একই ধরনের ভাগ হচ্ছে, তখন একটা প্রচণ্ড রকম দ্বিধাবিভক্ত রাজনীতি চলছে। এখন, আমরা ইনটেলেকচুয়ালরা পড়েছি ক্ষমতাবানের দিকে, এবং তার ফলে আমাদের চিন্তাধারা, আমরা যা নিয়ে লিখছি, যা নিয়ে চিন্তা করছি, যা নিয়ে ঝগড়া করছি, সেগুলো সবই ওই পথেই চলছে। তার ফলে ইনটেলেকচুয়ালদের কাছ থেকে সেই নেতৃত্ব সহজে আসছে না। ইংল্যান্ডে এক সময় লেবার পার্টি থেকে, অথবা জার্মানি, ফ্রান্স বা ইটালিতে বামপন্থী চিন্তাধারা থেকে যেটা এসেছিল, সেটা আসছে না। ইনটেলেকচুয়াল শাসক শ্রেণির— রুলিং ক্লাস-এর— মধ্যেই পড়বেন, এমন তো কোনও কথা নেই, কার্ল মার্ক্স অথবা আন্তোনিয়ো গ্রামশি শাসক শ্রেণির মধ্যে পড়েন, এটা তো বলা যাবে না! এবং আমাদের মধ্যেও মৌলিক বামপন্থী চিন্তাশীল লেখক ও বক্তা নেই এমনটাও নয়।
কিন্তু ইনটেলিজেনসিয়াকে একটা পুরো গ্রুপ যদি ধরা যায়, তা হলে সেই হিসেবে আমরা নিজেদের আইডেন্টিফাই করছি তাঁদের সঙ্গে, যাঁদের আক্ষেপ হল, কুকিং গ্যাসটা আর একটু সস্তা হলে ভাল হয়, ডিজেলের দামটা আর একটু কম হওয়া উচিত, কিংবা বিদ্যুতের মাসুলটা আর একটু কম করা হোক, যদিও শতকরা ত্রিশ ভাগ লোকের কোনও বিদ্যুতের কানেকশন নেই। আমরা যে সেই না-থাকাটা নিয়ে কিছু বলি না এবং বিদ্যুতের দাম নিয়ে কাগজে তার চেয়ে অনেক বেশি আলোচনা হয়, এই সব কারণেই অশোক রুদ্র বোধহয় বলবার চেষ্টা করেছিলেন যে, আমরা একটা ভিন্ন দলে পড়ে গেছি। এই সমস্যাটার সঙ্গে ওই উচ্চবর্ণ বা উচ্চ শ্রেণির আধিপত্যের একটা যোগ আছে ঠিকই। নিম্নবর্গের থেকে আমাদের আইডেনটিটির সাহচর্যের যে অভাব ঘটেছে, এবং তার সঙ্গে সঙ্গে, উচ্চ শ্রেণি যে সব সমস্যা নিয়ে চিন্তিত সেগুলির সঙ্গে আমরা যে ভাবে একাত্ম হয়ে গিয়েছি, তার পরিপ্রেক্ষিতেই অশোক রুদ্রের বক্তব্য ছিল যে, এই ইনটেলিজেনসিয়া থেকে আমাদের একটা নতুন নেতৃত্ব আসার সম্ভাবনা ক্রমশই ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। এটা নিশ্চয়ই ব্যতিক্রমহীন সত্য বলে মনে করার কারণ নেই, অশোকদা নিজেও তা জানতেন, না হলে তিনি ওই প্রবন্ধ লিখতেন না, তিনি নিজেও তো ওই দলেরই লোক (যেমন আমিও)। কিন্তু তিনি নানা সত্যের মধ্যে বড় সত্য বলে ওই কথাটা বলছেন এবং সেটা আমার কাছে খুবই বড় কথা বলে মনে হয়।
এখানেই কি নিম্নবর্গের নিজের কণ্ঠস্বর বা সক্ষমতার প্রশ্নগুলো খুব বড় হয়ে ওঠে না? যাদের একেবারে কোনও কণ্ঠস্বর নেই, সেই শিশুদের নিয়ে আপনাদের প্রতীচী ট্রাস্টেরই এক জনের লেখা পড়লাম। মিড ডে মিল প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, ‘যখন থেকে লেখাপড়া শিখেছি, বামপন্থী স্লোগান দেখে আসছি: দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে গর্জে উঠুন। এখন দেখছি, ডিজেল, রান্নার গ্যাস, এই সবের দাম নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে। কিন্তু গত পাঁচ বছরে ডাল এবং তেলের দাম বেড়েছে প্রায় একশো শতাংশ হারে। আর এই সময়ে মিড ডে মিল রাঁধার জন্য যে টাকা দেওয়া হয়, সেটা বেড়েছে তেত্রিশ শতাংশ। বাচ্চারা খাবে, তাদের জন্যে বলবার কেউ নেই। এক, তারা বাচ্চা; দুই, গরিব ঘরের বাচ্চা। এটা মিডিয়ায় আসে না, আমাদের অ্যাকাডেমিকরাও এ নিয়ে কিছু বলেন না। আবার, ফুলকপির দাম বেড়ে গেলে তা নিয়ে যত কথা হয়, চালের দাম আঠারো টাকা থেকে ছাব্বিশ টাকা হলে সেই তুলনায় কিছুই হয় না। এ নিয়ে বামপন্থী, দক্ষিণপন্থী, কারও কোনও উৎসাহ নেই।’ দক্ষিণপন্থীরা বলবেন না, তা হয়তো স্বাভাবিক, বামপন্থীদের তো বলার কথা!
সেটাই ঠিক। বামপন্থীদের কাছ থেকে আমরা যেগুলো আশা করতে পারতাম, সেগুলো তাঁরা অনেক সময়েই করে উঠতে পারেননি। তার জায়গায় সাম্রাজ্যবাদ রোধ করার কথাই বলে চলেছেন। সাম্রাজ্যবাদ নিশ্চয়ই রোধ করা দরকার। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ বামপন্থীরা ঠিক যে চেহারায় দেখছেন, পৃথিবীতে এখন সেটি সেই চেহারায় খুব বিরাট ভাবে আছে বলে আমি মনে করি না। একটা সাম্রাজ্যবাদ নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সেটা অনেক সূক্ষ্ম ভাবে আছে। সেটা বিচার করতে হলে সার্ত্র্ পড়া দরকার, গ্রামশি পড়া দরকার, তাঁরা এ বিষয়ে কী বলেছেন বোঝা দরকার। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ কথাটা যে ভাবে একটা খুব স্থূল অর্থে ব্যবহার করা হয়, বলা হয় আমেরিকা আমাদের সব কিছু নিয়ে নিল, স্কুল করতে দিচ্ছে না, হাসপাতালগুলো খারাপ করে দিল, সেটা তো সত্যি নয়! এবং সেটা যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁদের সেই বিশ্বাস দূর করাটা কঠিন হবে, কারণ বিশ্বাসটা ঠিক কোথা থেকে আসছে, তা বোঝা কঠিন। এখন, এটা বললেই লোকে বলবেন যে, ‘আপনি সাম্রাজ্যবাদকে সমর্থন করছেন’। তাতে আমি বলতে পারি যে, আমি সাম্রাজ্যবাদের ভীষণ বিরোধিতা করছি, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদটা কোথায় কোন ফর্মে হচ্ছে, সেটা তো আমাদের জানা দরকার। সাম্রাজ্যবাদের ফলে আমাদের অনেক কিছু ক্ষতি হতে পারে, কিন্তু কোথায় কী কী ক্ষতি হচ্ছে, সেটা পরিষ্কার ভাবে বিশ্লেষণ করাটা খুবই জরুরি। |
|
|
|
|
|