কিছু ঘটনা আপাতদৃষ্টিতে ক্ষুদ্র হইলেও ভিতরে বৃহৎ বিপদ-সম্ভাবনা বহিয়া বেড়ায়। মধ্যমগ্রামের নির্যাতিত ও নিহত কিশোরীটির প্রসঙ্গে বিহার সরকার যে কাণ্ড করিল, তাহা তেমনই একটি ঘটনা। হৃদয়বিদারক এই মৃত্যুর পর পশ্চিমবঙ্গ জুড়িয়া যখন শোকের গভীর ছায়া, রাজনীতির তীব্র খেয়োখেয়ি, তাহার মধ্যে হঠাৎ অবতীর্ণ হইল বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশকুমারের অর্থসহায়তা, এবং, আরও গুরুতর, তাঁহার প্রেরিত তদন্ত-সাহায্য। উল্লিখিত পরিবারটি যে বিহার হইতে কর্মসূত্রে পশ্চিমবঙ্গে আসিয়াছিল, তাহা শুনিয়াই নীতীশকুমারের এই তড়িঘড়ি পদক্ষেপ। এই অবিমৃশ্যকারিতা কেবল অবাঞ্ছিত নয়, অতিশয় বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করিল। প্রথমত ইহাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অসম্মান। বিহার কিংবা অন্য যে কোনও রাজ্য হইতে যাঁহারা কর্মসূত্রে এ রাজ্যের বাসিন্দা হইয়া পড়িয়াছেন, রাজ্যের মধ্যে যে কোনও পরিস্থিতিতে তাঁহাদের দায়িত্ব পশ্চিমবঙ্গ সরকারেরই। অন্য রাজ্যের নাগরিকের সংকটে যদি সেই রাজ্যের তদন্তকারী অফিসার পাঠানো হয়, তবে তদ্দ্বারা এই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা-রক্ষাকারীদের প্রতি চূড়ান্ত অনাস্থা প্রকাশ করা হইতেছে, এমনটাই বুঝিতে হইবে। দ্বিতীয়ত, ইহাও বুঝিতে হইবে, এই পদক্ষেপের মধ্যে একটি স্পষ্ট বার্তা রহিয়াছে: কোনও রাজ্যের নাগরিকের ভার কেবল সেই রাজ্যের সরকারেরই, অর্থাৎ অন্য রাজ্য তাহার অস্থায়ী বাসিন্দার দায়িত্ব লইতে অক্ষম। কোনও রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার বিষয়টি সেই রাজ্যের প্রতিটি বাসিন্দার জন্যই কার্যকর হয়, সেখানে স্থায়ী-অস্থায়ী বাসিন্দার মধ্যে বিভাজন থাকিতে পারে না। বিশেষ প্রয়োজন না হইলে কেন্দ্রীয় সরকারও আকস্মিক কোনও রাজ্যে পুলিশ পাঠাইতে পারে না। ইহা বৃহৎ যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশের পালনযোগ্য পদ্ধতি নহে।
এমন অপরিণামদর্শী অবিবেচনা যে সম্পূর্ণ অদৃষ্টপূর্ব, তাহা নহে। খালিস্তান-দমন পর্বে পঞ্জাব পুলিশের অত্যুৎসাহে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুমতি ব্যতিরেকেই এ রাজ্যে বেশ কয়েকটি ‘রেড’ ঘটিয়া যাইবার পর রাজ্য সরকারের পক্ষ হইতে পঞ্জাবের বিরুদ্ধে অভিযোগও দাখিল হইয়াছিল। যদিও কোনও নিয়মভঙ্গের শাস্তি কাহারও জোটে নাই, নিয়ম যে স্পষ্টত ভঙ্গ হইয়াছিল, তাহা সর্বসম্মত ছিল। উল্লেখ্য, সে দিনে সেই বিতর্কোর্ধ্ব ‘অন্যায়’-এর পিছনেও কিন্তু একটি জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন ছিল, জঙ্গি চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষিত ছিল: এই সাম্প্রতিক ঘটনাটির সঙ্গে তাহা তুলনীয় নহে। সাম্প্রতিক ঘটনাটি কেবল স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত সমস্যা, প্রাদেশিক সরকারের প্রাথমিক কাজগুলির অন্যতম।
কেন এই ধরনের অবিমৃশ্যকারিতায় প্রলুব্ধ হইতে হয়, তাহা অবশ্য দুর্বোধ্য নহে। রাজনৈতিক জমি পায়ের তলা হইতে সরিতে আরম্ভ করিলেই জনমনোরঞ্জনের উদ্ভ্রান্ত ঈপ্সায় এ হেন কাণ্ড ঘটাইতে হয়। জে ডি (ইউ) প্রধান নীতীশ কুমারের দিন ভাল যাইতেছে না। মোদীর প্রশ্নে বিজেপি তাঁহার দল ভাঙাইয়া লইতেছে, একের পর এক বিধায়ক বিদ্রোহ ঘোষণা করিতেছেন, নীতীশ কুমারের ক্রমবর্ধমান কংগ্রেস-ঘনিষ্ঠতায় জে ডি (ইউ)-এর আদ্যন্ত কংগ্রেস-বিদ্বিষ্ট অন্যতম মহানেতা শরদ পাওয়ার সেই বিদ্রোহীদের ক্ষোভে ফুলকি জোগাইতেছেন, আবার উপনির্বাচনে আর জে ডি-র প্রার্থীর বিরাট জয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রাদেশিক নেতা লালুপ্রসাদের হাস্যমুখ অবিচল। বিশেষত চিরশত্রু নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসাবে জাতীয় বরণ-পর্ব নিশ্চয়ই নীতীশের প্রাণে একটুও স্বস্তি দিতেছে না। কিন্তু রাজনৈতিক অনিরাপত্তার ফাঁদে পড়িয়া এই ভাবে বিপজ্জনক পদক্ষেপ লইলে তাঁহার অবশিষ্ট খ্যাতিও বিপন্ন হইবার সম্ভাবনা। নীতীশকুমার জাত-রাজনীতিক, বিচক্ষণ বলিয়াও যথেষ্ট সুনাম। এই সহজ হিসাবটি তাঁহার মাথায় রাখা উচিত ছিল। |