ফের ছোট আঙারিয়া মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হল। সোমবার, মেদিনীপুর জেলা আদালতে সাক্ষ্য নেওয়া হয় বক্তার মণ্ডলের স্ত্রী আয়েশা বিবি ও রফিক মণ্ডলের। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্য দেবে সিদ্দিক মণ্ডল।
দ্বিতীয় দফার ছোট আঙারিয়া মামলার শুনানি শুরু হয়েছিল ২০১২ সালের ৮ এপ্রিল। প্রথম দিনেই বক্তার মণ্ডলের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। দ্বিতীয় দিনে বক্তারের সাক্ষ্যকে ঘিরে জোর বিতর্ক হয় দু’পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে। প্রথমবার শুনানির সময় যে বক্তার মণ্ডলকে বিরূপ ঘোষণা করা হয়েছিল সেই বক্তারই দ্বিতীয় দফার শুনানিতে দাবি করেন, ২০০১ সালের ৪ জানুয়ারি ছোট আঙারিয়া গ্রামের পরপর কয়েকজনকে খুন করেছিল সিপিএম। পাশের বাঁশ ঝোপ থেকে তা তিনি স্বচক্ষে দেখেছিলেন। সিপিএম নেতাদের হুমকিতে এর আগের বার মিথ্যে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করেছিলেন বলে আদালতে দাবি করেন বক্তার। অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী রানা গঙ্গোপাধ্যায় সেই সময় আদালতের কাছে দাবি করেন, বক্তার মণ্ডল, আয়েশা বিবি, রফিক মণ্ডল ও সিদ্দিক মণ্ডলযে চার জন আগের বার সাক্ষ্য দিয়ে বিরূপ হয়েছিলেন, তাঁদের পরপর সাক্ষ্য নিক সিবিআই। তারপরই পাল্টা জেরা করবেন তিনি। সিবিআইয়ের আইনজীবী তাপস বসু এর প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, তিনি কার সাক্ষ্য নেবে তা অন্য কেউ ঠিক করে দিতে পারে না। এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যান অভিযুক্তপক্ষের আইনজীবী। হাইকোর্ট অবশ্য পরপর চারজনের সাক্ষ্য গ্রহণের পক্ষেই রায় দিয়েছে।
এ দিকে, এই জটিলতায় মেদিনীপুর আদালতে শুনানি পিছিয়ে গিয়েছিল। হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে সোমবার থেকে পরপর ওই চার জনের শুনানি শুরু হয়।
সোমবার আয়েশা বিবি সাক্ষ্য দিতে গিয়ে জানান, ২০০১ সালের ৪ জানুয়ারি সন্ধে ৬টা নাগাদ তাঁর স্বামী বক্তার-সহ ১৫ জন বাড়িতে আসেন। বাড়িতে এসেই বক্তার স্ত্রীকে চা করতে বলে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যান। আয়েশার কথায়, “ওঁরা ফিরে এসেছে দেখে আমি তো অবাক। জিজ্ঞেস করলাম কেন ফিরেছ? তখন স্বামী জানালেন, সিপিএম নেতারাই বলেছে বাড়ি ফিরতে। চিন্তার কিছু নেই।” আয়েশা বিবি জানান, কিছুক্ষণ পরেই চারদিক থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শুনতে পান তিনি। এমন সময় মায়ের সঙ্গে দেখা করে স্বামী বাড়িতে ফেরেন। স্ত্রী-র কাছে জানতে চান, চা করতে কত দেরি। আয়েশা বলেন, “সেই সময় নিয়াজ খান নামে গ্রামেরই এক জন এসে স্বামীকে বলে সিপিএমের লোকজন গ্রাম ঘিরে ফেলেছে, পালিয়ে যাও। ও তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। আমিও পাশেই বাপের বাড়িতে ঢুকে যাই।” আদালতে দিল মহম্মদকে শনাক্তও করেন আয়েশা। যদিও অভিযুক্তপক্ষের আইনজীবী প্রতিবাদ করে জানান, এটা জোর করে চেনানো হচ্ছে।
বক্তার মণ্ডলদের সঙ্গেই বাড়ি ছাড়া হয়ে গড়বেতা পার্টি অফিসে ছিলেন চমকাইতলার রফিক মণ্ডল। তাঁর দাবি, বক্তারের সঙ্গে ওই দিনই ছোট আঙারিয়া গ্রামে ফিরেছিলেন তিনিও। এদিন সাক্ষ্য দিতে গিয়ে রফিক জানান, তাঁরা সব মিলিয়ে ১৫ জন বক্তারের বাড়িতে ফিরেছিলেন। খড়কুশমা হয়ে ছোট আঙারিয়া গ্রামে ঢোকেন তাঁরা। ৫ জন বাড়ির দোতলায় ছিলেন। বাকি ১০ জন ছিলেন নীচে। রফিকের কথায়, “চারদিকে চিৎকার-চেঁচামেচি হচ্ছে শুনে বাইরে বেরিয়ে দেখি সিপিএমের লোক গ্রাম ঘিরে ফেলেছে। বক্তারের বাড়ির পাশে তখন হাজির হয়ে গিয়েছে প্রশান্ত পাল, ভোলা, বাবলা, সালেমতরা। ওরা সকলকে বাড়ির বাইরে বেরোতে বলছে। প্রথমে বাড়ির বাইরে বেরোয় মোক্তার। বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই প্রশান্ত পাল ধারালো তলোয়ার দিয়ে মোক্তারের গলা কেটে দেয়। দিল মহম্মদও তলোয়ার দিয়ে মোক্তারের শরীরে আঘাত করে।” এভাবেই রবিয়াল, হায়দার-সহ ৫ জনকে কুপিয়ে ও গুলি করে খুন করা হয়েছে বলে আদালতে রফিক জানান। রফিকের কথায়, “আমি প্রথমে বাঁশ ঝোপে লুকিয়ে তা দেখি। তারপর সুযোগ বুঝে পালিয়ে যাই শোলতোড়া গ্রামের কাছে। সেখানে একটি খালের ধারে কিছুক্ষণ বসে থাকি। সেখান থেকে গুলির শব্দ ও বাড়িতে আগুন লাগানোও দেখি। তার সঙ্গে সকলের আর্ত চিৎকারও শুনতে পাই।” শেষে সিবিআইয়ের আইনজীবী প্রশ্ন করেন, “কেন প্রথমবার তিনি সত্য বলেননি?” উত্তরে রফিক জানান, “সিপিএম নেতা তপন ঘোষ, সুকুর আলি, দিবাকর ভুঁইয়ারা আমার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বলে দিয়েছিল, সত্য কথা বললে খুন করে দেবে। তাই ভয়ে বলতে পারিনি।” এটাও আদালত রেকর্ড করায় তীব্র প্রতিবাদ জানান অভিযুক্তপক্ষের আইনজীবী। তা বাতিলের আবেদনও জানান। যদিও বিচারক ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য তা খারিজ করে দেন। এর বিরুদ্ধে ফের হাইকোর্টে যাবেন বলে জানিয়েছেন অভিযুক্তপক্ষের আইনজীবী।
|