সব ঠিক আছে তো? নিজেরই গায়ে-মাথায়, বুকে হাত বুলিয়ে দেখে নিলেন বার কয়েক। একই কথা শুনতে শুনতে একটু যেন গা শিরশির করছিল বাসুদেবের। মনে হচ্ছিল, সত্যিই বেঁচে আছি তো?
প্রত্যয় হওয়ার পরে খানিক বিরক্তি জন্মাল। ভিড় ঠেলে নিজের বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকে স্ত্রীকে দেখে চিৎকার করে বললেন, “কান্নাকাটি থামাও। আমি বেঁচে আছি।” তাতেও কান্না বাগ মানছে না দেখে, গলার স্বর আরও দু’পর্দা চড়িয়ে বললেন, “এই তো আমি, দিব্যি বেঁচে আছি। পোস্টমর্টেমও হয়নি।”
শান্তিপুরে ভ্রান্তিবিলাসের নায়ক বাসুদেব শর্মাকে ঘিরে আত্মীয়-পরিজনদের বিমর্ষ ভিড়টা মুহূর্তে যেন উৎসবে পরিণত হল।
কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে জীবদ্দশায় নিজের স্ত্রীর বৈধব্যের বিলাপের সাক্ষী থাকলেন বাসুদেববাবু? |
শান্তিপুর স্টেশন-সংলগ্ন এলাকার রাস্তা থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক অসুস্থ প্রৌঢ়কে এলাকার কিছু যুবক শান্তিপুর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান রবিবার বিকেলে। পথেই মারা যান ওই ব্যক্তি। হাসপাতালে তখন ছিলেন গোবিন্দপুর কায়স্থপাড়ার বাসিন্দা বাসুদেববাবুর এক পড়শি। মৃতদেহের মুখ দেখে তিনি গম্ভীর ভাবে ঘাড় হেলিয়ে জানিয়ে দেন, “এ তো আমাদের পাড়ার বাসুদেব শর্মা।” তিনিই খবর দেন পাড়ায়। পেশায় কাঠমিস্ত্রি বাসুদেবের বাড়িতে কান্নার রোল ওঠে।
সন্ধে ৬টা নাগাদ হাসপাতালে আসেন বাসুদেবের মেজো ছেলে রিপন। শান্তিপুর হাসপাতালে জরুরি বিভাগের সামনে সাদা কাপড়ে ঢাকা দেহের মুখটুকু দেখে নিজের বাবা বলেই নিশ্চিত হন বছর উনিশের যুবক। সদ্য পিতৃহারা রিপনকে ‘এমন কঠিন সময়ে শক্ত থাকা’র পরামর্শ দিতে শুরু করেন তাঁর সঙ্গে আসা পাড়া-প্রতিবেশীরাও।
ময়না-তদন্তের জন্য দেহ পাঠানোর কথা রানাঘাট পুলিশ মর্গে। তার আগে দেহ শান্তিপুর থানায় আনে পুলিশ। সেখানে আসেন বাসুদেবের বড় ছেলে, বছর বাইশের বাপন। তিনিও দেহ শনাক্ত করেন। পুলিশ এ বার সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির কাজ শুরু করে।
এর পরেই কহানীর আসল টুইস্ট। রাত ৮টা নাগাদ কাজকর্ম সেরে বাড়ি ফেরেন বাসুদেব। খেয়াল করেন, পাড়ায় তাঁকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠছেন অনেকে। ফিসফাস ভেসে আসছে এ দিক ও দিক থেকে। বাড়ি ঢোকার আগে তো এক জন জিজ্ঞাসাই করে বসলেন, “তুমি বেঁচে আছো বাসুদেব?”
লোকটি তাঁর শুভানুধ্যায়ী কিনা ভাবছিলেন প্রৌঢ়। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘরে ঢুকে পড়ার পরেই দীর্ঘ নাটকের যবনিকা পতন হতে পারত। কিন্তু অন্তিম দৃশ্য তখনও বাকি। এ বার ঘটনাস্থল শান্তিপুর থানা।
প্রতিবেশীর ফোন থেকে বাপনকে মোবাইলে বাসুদেব নিজেই ফোন করেন। ছেলেকে বলেন, “আমি তোর বাবা রে। চিনতে পারছিস? আমি মরিনি। যে কাজে তোরা থানায় গিয়েছিস, সেটা ঠিক নয়। বাড়ি ফিরে আয়।” কথাটা নিজের কানে শুনে তখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না বাপন। গাঁয়ের পাঁচ জন মাতব্বরের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক হয়, আরও এক বার দেখা হোক বডি। নাঃ, এ বারও তো মুখটা বাবারই মনে হচ্ছে, জানালেন দুই ভাই। প্রতিবেশীরাও সহমত। তা হলে বাড়িতে কে? চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জনের জন্য রিপন-বাপনরা এ বার বাড়িমুখো। বাড়ির সামনে বাবাকে ঘিরে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি দুই ভাই।
কিন্তু এমন ভুল হল কী করে? রিপন-বাপনেরা বলেন, “অনেক বার করে দেখেছি চেহারাটা। বাবার বলেই তো মনে হয়েছিল। আর বাবার তো মোবাইল নেই। জানতেও পারছিলাম না কোথায় আছে।” প্রতিবেশী শ্রীবাস শর্মা, কৌশিক ঘোষরাও বললেন, “এ তো দেখছি, নিজের চোখকেও অবিশ্বাস করতে হচ্ছে। হুবহু এক চেহারা।” বাসুদেব জানান, কাজকর্ম মিটিয়ে বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু মাঝে এত কাণ্ড বাধবে, কে জানত।
রানাঘাটের এসডিপিও আজহার এ তৌসিফ বলেন, “ছেলেরা এসে চিহ্নিত করল, এটা তাদের বাবার মৃতদেহ। সেই মতো কাগজপত্রও তৈরি করা শুরু করেছিলেন কর্তব্যরত অফিসার। তারপরেই জানা যায়, একটা ভুল হচ্ছিল।”
যাঁর সঙ্গে নাকি তাঁর মুখের এত মিল, সেই অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির ঠিকানা এখন লাশকাটা ঘর। তাঁকে একবার দেখতে সাধ বাসুদেবের। মিন মিন করে একবার কথাটা পেড়েছিলেন বাড়িতে। স্ত্রীর ধমকে ক্ষান্ত দিয়েছেন। |