বহরমপুরের প্রাণকেন্দ্র কাদাই অঞ্চলে একটি আবাসনের ফ্ল্যাটের মধ্যে তিন মহিলা খুনের ঘটনায় হতবাক এলাকার বাসিন্দারা।
এক সময়ে যা বহরমপুরের শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র ছিল, প্রায় ১৩ বছর আগে সেই ‘বিমল কালচারাল হল’ ভেঙে গড়ে ওঠে এই আশাবরী আবাসন কমপ্লেক্স। ‘এ’ ব্লক থেকে ‘এফ’গত কয়েক বছরে ওই ছ’টি ব্লকে প্রায় দেড়শোটি ফ্ল্যাট তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানও। ফলে জনবহুল ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ওই আবাসনের যে কোনও ব্লকের যে কারও ফ্ল্যাটের মধ্যে ঢুকে যে কেউ কোনও ঘটনা ঘটিয়ে বেরিয়ে গেলে কারও পক্ষে প্রকৃত ঘটনার প্রেক্ষাপট জানা অসম্ভব। ওই আবাসনের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। তাঁরা শিউরে উঠছেন এই ভেবে যে, আবাসনের মধ্যেই একটি ফ্ল্যাটে তিন মহিলাকে খুন করে ফেলে রাখা হল, তা তাঁদের প্রতিবেশীরা কেউ জানতেই পারলেন না প্রায় গোটা দু’দিন ধরেও। |
ওই আবাসনের বাসিন্দা পেশায় সরকারি কর্মী শিবানী বিশ্বাস বলেন, “ওই খুনের ঘটনায় আমরা বিশেষ করে মহিলারা আতঙ্কিত বোধ করছি। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। অবিলম্বে আবাসনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা উচিত। সেই সঙ্গে দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রান্ত নিরাপত্তারক্ষী ফ্ল্যাটগুলিতে নিয়োগ করতে হবে। আমি চাই আবাসনে যাতায়াতের পথে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরাও বসানো হোক।”
পেশায় শিক্ষক অন্য এক আবাসিক প্রদীপ্ত রায় বলেন, “বাড়িতে স্ত্রী এবং ছেলে থাকে। আগে তাদের বাড়িতে রেখে নিশ্চিন্তে স্কুল যাতায়াত করলেও এখন সেই ভরসার জায়গাটা কোথাও নষ্ট হয়ে গেল বলে মনে হচ্ছে।” সেই সঙ্গে বহরমপুরের মত মফস্সল শহরে গড়ে ওঠা ‘ফ্ল্যাট কালচার’ ওই তিন মহিলা খুনের ঘটনায় ধাক্কা খেল বলেও পুর-নাগরিকরা মনে করছেন। |
যদিও ২০০৫ সালে গোরাবাজারের একটি বাড়িতে রাতের অন্ধকারে শাশুড়ি ও বৌমার এক সঙ্গে পুড়ে ‘রহস্যজনক’ মৃত্যুর ইতিহাসের সাক্ষীও রয়েছে বহরমপুর। শাশুড়িকে ঘরের মধ্যে আগুনে দাউদাউ করে জ্বলতে দেখে বৌমাও আগুনে আত্মঘাতী হন বলে পুলিশের তদন্তে উঠে আসে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উদ্ঘাটন হয়নি প্রকৃত ঘটনা। ফলে এখন পর্যন্ত তা অন্তরালে রয়ে গিয়েছে।
এদিকে ঘটনার খবর পেয়ে রেজিনগরের সভা থেকে তড়িঘড়ি বহরমপুরে ফিরে সরাসরি ওই আবাসনে চলে যান রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী। সেখানে আবাসিকদের সঙ্গে কথা বলে প্রকৃত ঘটনা জানার চেষ্টা করেন। ‘চিন্তিত’ অধীরবাবু বলেন, “মনে হচ্ছে পরিকল্পিত ভাবে ঠান্ডা মাথায় খুন করে তালা মেরে চলে গিয়েছে। খুনি ওই পরিবারের পরিচিত কেউ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে সবটাই নির্ভর করছে পুলিশের তদন্তের উপরে।” তাঁর কথায়, “বহরমপুর শহরে শান্তি-শৃঙ্খলা থেকে নিরাপত্তা ছিল। এখন সেই নিরাপত্তা হারিয়ে যচ্ছে। নিরাপত্তার দায়িত্ব প্রশাসনের। কিন্তু রাজ্যে প্রশাসন বলে কিছু নেই। ফলে প্রশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণের মানুষের অভিযোগ বাড়ছে। ওই খুনের ঘটনা স্বাভাবিক ভাবেই বহরমপুরের নিরীহ-শান্ত-শিক্ষিত নাগরিকদের অত্যন্ত দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলে গেল বলে মনে করছি। আমি নিজেও ভীষণ চিন্তিত।” |
উদ্বিগ্ন প্রতিবেশীরা। |
খুনের কথা শুনে আবাসন চত্বরে এলেন অধীরও। |
|
ওই আবাসনের বাসিন্দা পেশায় চিকিৎসক অপূর্বলাল দত্ত বলেন, “আবাসনে এই ধরনের ঘটনা ঘটলে কী ভাবে ভাল থাকব?” নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনিও। আর এক আবাসিক চন্দ্রাণী হাজরা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “চার বছর ধরে আবাসনে বাস করছি। জনবহুল এলাকায় এই ধরনের কোনও ঘটনা ঘটবে কোনও দিন ভাবতে পারিনি। ফলে কিছুটা হলেও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ফ্ল্যাটে এই ধরনের ঘটনাও সম্ভবত বহরমপুরে এই প্রথম। ফলে সব মিলিয়ে মানসিক একটা অস্থিরতার মধ্যে সময় কাটাচ্ছি।”
বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ অধ্যক্ষ সোমেশ রায় বলেন, “শহরের নিজস্ব একটা সংস্কৃতি ছিল, তা হলো পাড়া-সংস্কৃতি। এখন কেমন যেন আমি ও আমার পরিবারের মধ্যে আমরা সকলে আবদ্ধ হয়ে পড়েছি। এখন কেউ কারও জন্য নয়। ফলে একা ও নিঃসঙ্গতায় ভুগছে মানুষ। সেই পাড়া-সংস্কৃতির অবলুপ্তি ঘটায় তাঁদের নিঃসঙ্গতাও বেড়েছে। একলা হয়ে যাওয়া জীবনই ওই ঘটনার জন্য দায়ী।”
|