বহরমপুর শহরের প্রাণকেন্দ্র কাদাইয়ের আশাবরী নামে একটি আবাসনের ফ্ল্যাটের দরজার তালা ভেঙে উদ্ধার করা হল একই পরিবারের তিন মহিলার মৃতদেহ। তাঁদের নাম প্রভা দাস (৭১), বিজয়া বসু (৪৮) এবং আত্রেয়ী বসু (১৮)। বিজয়াদেবীর মেয়ে আত্রেয়ী। প্রভাদেবী বিজয়াদেবীর পিসি। এই তিন জনেই আবাসনের ডি ব্লকের একতলার ওই এক কামরার ফ্ল্যাটটিতে থাকতেন। আত্রেয়ীয়ের গায়ে কোনও পোশাক ছিল না। অর্ধনগ্ন অবস্থায় ছিলেন বিজয়াদেবীও। ওই বাড়ির বাথরুমে বেশ কয়েক ফোঁটা রক্ত পাওয়া গিয়েছে। মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, “তিন জনকেই শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে। তবে তাঁদের কাউকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে আমাদের মনে হয়নি। ময়না-তদন্তের রিপোর্ট পেলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।”
এই ঘটনার জন্য কে দায়ী, তা নিয়ে পুলিশ নিশ্চিত নয়। তবে বিজয়াদেবীর দিদি ইরা মিত্র বলেন, “বিজয়ার স্বামীকেই আমরা সন্দেহ করছি। সে নিজের হাতে খুন করতে পারে। আবার লোক লাগিয়েও নিজের মেয়ে, স্ত্রী ও পিসশাশুড়িকে খুন করাতে পারে।” বিজয়াদেবীর স্বামীর সঙ্গে অবশ্য এই পরিবারের বছর দু’য়েক ধরেই কোনও সম্পর্ক নেই। তিনি এখন কোথায় থাকেন, তা-ও পরিবারের কেউ জানেন না। ইরাদেবী জানান, সম্প্রতি বিজয়াদেবী তাঁর স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ চেয়ে মামলা করেছিলেন। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ইরাদেবীদের অভিযোগের ভিত্তিতেই বিজয়াদেবীর স্বামীর বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় খুনের মামলা দায়ের করে তদন্ত শুরু হয়েছে। |
ইরাদেবীরা থাকেন বহরমপুরেরই খাগড়া ঘাটবন্দর এলাকায়। তাঁদের সঙ্গে বিজয়াদেবীদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। ইরাদেবী জানান, বৃহস্পতিবার ফোনে বিজয়াদেবীর সঙ্গে তাঁদের শেষ কথা হয়েছে। তারপরে রবিবার সকালে ফোন করলে দেখা যায় তিন জনের মোবাইল ফোনই বন্ধ। তখন ইরাদেবীর স্বামী কৃষ্ণাশিস মিত্র দুপুরে কাদাইয়ে বিজয়াদেবীদের ফ্ল্যাটে এসে দেখেন, বাইরে থেকে তালা ঝুলছে। আশেপাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন, শনিবার গভীর রাতে ওই বাড়িতে আলো জ্বলছিল। কিন্তু তারপর থেকে আর কারও দেখা মেলেনি। রবিবার রাতে আরও একবার গিয়েও দরজা তালা বন্ধ দেখে ফিরে আসেন কৃষ্ণাশিসবাবু। এরপরে সোমবার দুপুরে গিয়েও একই অবস্থা দেখে তিনি পুলিশে খবর দেন। বহরমপুর থানার পুলিশ গিয়ে তখন দরজার তালা ভেঙে ঢুকে দেখে শোওয়ার ঘরের মেঝেতে পড়ে রয়েছে বিজয়াদেবীর দেহ। তাঁর মাথার নীচে বালিশ দেওয়া রয়েছে। খাটের এক পাশে প্রভাদেবীর দেহ, অন্য দিকে আত্রেয়ীয়ের দেহ। প্রভাদেবীর দুই হাত খাটের ছতরির সঙ্গে বাঁধা ছিল। আত্রেয়ীয়ের হাত দু’টি বাঁধা ছিল পিছমোড়া করে। তবে বাথরুমে কেন রক্ত পাওয়া গেল, তার কোনও কারণ পুলিশ এখনও পর্যন্ত জানাতে পারেনি।
তবে পুলিশের অনুমান, যে ব্যক্তিই খুন করে থাকুন, তিনি ওই পরিবারের পরিচিত। বাড়িতে ধস্তাধস্তির সে রকম কোনও চিহ্ন নেই। ওই আবাসনের কেয়ারটেকার পুলিশকে জানিয়েছেন, শনিবার রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ এক ব্যক্তিকে তিনি বিজয়াদেবীদের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছেন। সেই ব্যক্তি একটি মোটরবাইক করে বেরিয়ে যান।
বহরমপুর থানার আইসি মোহায়মেনুল হকের বক্তব্য, “প্রাথমিক ভাবে অনুমান, শনিবার গভীর রাতেই ওই তিন জনকে খুন করা হয়েছে। তবে তাঁদের কারও দেহেই পচন ধরেনি। যে কারণেই ওই আবাসনে তাঁদের প্রতিবেশীরা কেউ কোনও গন্ধ পাননি।” পুলিশের অনুমান, প্রভাদেবীর গলায় মাফলার পেঁচিয়ে এবং বিজয়াদেবী ও আত্রেয়ীকে টুকরো কাপড় দিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়। এ দিন পুলিশ ঘরে গিয়ে দেখে, আলমারি খোলা, তার চাবিটা ঝুলছে বাইরে থেকে। গয়নার বাক্সগুলো নীচে নামানো। কয়েকটি সোনার গয়না পড়ে রয়েছে আলমারির সামনে। ঘরের ভিতরের অন্য জিনিসপত্র মোটামুটি ঠিকই রয়েছে। কেবল আলমারির পাশেই ঠাকুরের জায়গায় সিঁদুর কৌটো উল্টে ছিল। ঠাকুরের বাসনপত্রও এপাশ ওপাশ ছড়ানো। রান্নাঘরে খোসা ছাড়ানো আলু রাখা ছিল একটি পাত্রে। তিনটি খাবারের এঁটো প্লেট রাখা ছিল নীচে। একটি চায়ের কাপও রাখা ছিল সেখানে। ইরাদেবী বলেন, “আমাদের সন্দেহ, টাকা ও গয়নাগাঁটির লোভে বিজয়ার স্বামীই এই কাণ্ড করেছে। তবে কিছু গয়না সম্ভবত কোনও কারণে সে নিয়ে যেতে চায়নি। সেগুলি ফেলে গিয়েছে।”
পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, বিজয়াদেবীর স্বামীর বিরুদ্ধে একাধিক লোককে ‘ঠকিয়ে’ টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বহরমপুরেরই এক শল্য চিকিৎসকের নার্সিংহোমে তিনি এক সময়ে ম্যানেজারের চাকরি করতেন। টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সেই চাকরি চলে যায়। তারপরে বিভিন্ন ব্যক্তিকে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বা ধার করে কয়েক লক্ষ টাকা নিয়ে তিনি পালিয়ে যান। প্রভাদেবীর ৬৩ হাজার টাকাও তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন বলে পরিবারের তরফে দাবি করা হয়েছে। কৃষ্ণাশিসবাবুর বক্তব্য, “স্বামীর কাজকর্মে অতিষ্ঠ হয়ে বিজয়াদেবীই তাঁকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছিলেন। সেই থেকে আমার ভায়রাভাইয়ের কোনও খোঁজ আমরা পাইনি।”
বিজয়াদেবীর বিয়ে হয়েছিল ১৯৯০ সালে। উচ্চ মাধ্যমিকে পরীক্ষার্থী আত্রেয়ী পড়ত বানজেটিয়ার প্রভারানি পাবলিক স্কুলে। বিজ্ঞানের ছাত্রী আত্রেয়ী জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেওয়ারও প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বিজয়াদেবীদের সংসার চলত প্রধানত তাঁর পিসি প্রভাদেবীর পেনসনের টাকাতেই। প্রভাদেবী ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়ার প্রাক্তন কর্মী। তাঁর প্রয়াত স্বামী ছিলেন পোস্টমাস্টার। বিজয়াদেবী নিজে অবশ্য সম্প্রতি জীবনবিমার এজেন্টের কাজ শুরু করেছিলেন।
ওই ফ্ল্যাটের সামনেই একটি বইখাতার দোকান রয়েছে। তার মালিক সুকুমার দেবনাথ বলেন, “শনিবার সন্ধ্যায়ও বিজয়াদেবী ও আত্রেয়ীকে দেখেছিলাম। ফুটফুটে মেয়েটাকে যে এ ভাবে কেউ খুন করতে পারে, তা কল্পনারও বাইরে।” পুলিশ মৃতদেহগুলি নিয়ে যাওয়ার সময়ে গোটা আবাসনই ভেঙে পড়ে সেখানে। বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরীও সেখানে পৌঁছন। তিনি বলেন, “মনে হচ্ছে পরিকল্পিত ভাবে ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে। পরিচিত কেউ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।” |