|
|
|
|
আশার আবহে টেনশনের চোরাস্রোত
রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায় • কলকাতা |
বাংলার রঞ্জিজয়ী অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় আজ ইডেনে লক্ষ্মীরতন শুক্লর হাতে দশ জন প্রাক্তন বঙ্গ অধিনায়কের সই করা ব্যাটটা ধরিয়ে একটা জঙ্গিসুলভ বার্তা আগাম দিয়ে রাখতে চান। “লক্ষ্মীকে বলব, মুরলী কার্তিকদের গালিগালাজটা তোমরা শুরু করো। একেবারে প্রথম দিন থেকে। ওরা দিল্লিতে তোমাদের সঙ্গে যে ব্যবহারটা করেছে, তার তিনশোগুণ ফিরিয়ে দাও! তবে সঙ্গে ভাল ক্রিকেটটাও খেলো।”
লক্ষ্মীর টিম বাংলার ধরন-ধারণ দেখে রাজু মুখোপাধ্যায়ের কোথাও গিয়ে মনে হচ্ছে, ’৮৯-’৯০ আবার ফিরছে। টিমটা এগোচ্ছে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দিকে। গোপাল বসু বিশেষ কিছু বলতে চান না। চান শুধু তামিলনাড়ু ম্যাচে বাংলার সেই মাইন্ডসেট। দেবাঙ্গ গাঁধী নিজেই নিজের পিঠ আজ চাপড়ে দিচ্ছেন! কেন? না, দু’বছর আগে লক্ষ্মীকে বাংলার ক্যাপ্টেন্সি থেকে সরানোটা নাকি ‘মাস্টারস্ট্রোকে’ দাঁড়িয়েছে! দেবাঙ্গের যুক্তি, সে দিন ফর্ম ছিল না বলে নির্বাচক কমিটির প্রধান হিসেবে সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন। কারণ বর্তমান বঙ্গ অধিনায়ককে নাকি চাপমুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন। শুনতে যতই হাস্যকর লাগুক, দেবাঙ্গ বললেন তাঁর ওই ‘মুভে’ নাকি লক্ষ্মীর ফর্ম ফিরেছে, দুর্দান্ত ক্যাপ্টেন্সিটাও করছেন। এবং এখন লক্ষ্মীকে ‘ওয়েল বোল্ড’ বা ‘ব্যাটেড ওয়েল’ নয়, বলতে পারেন ‘ওয়েল ক্যাপ্টেন্ড!’
বাংলার প্রাক্তন অধিনায়করা শুধু নন। বাংলার সমস্ত প্রাক্তন ক্রিকেটারকেই আগামী বুধবার থেকে কোয়ার্টার ফাইনাল দেখতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে সিএবি। বাড়িতে চাইলে গাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ম্যাচের সমস্ত টিকিট সর্বসাধারণের জন্য বিনামূল্যে, এবং বিভিন্ন কোচিং সেন্টার, স্কুলকে এ দিন বলে দেওয়া হল, কোয়ার্টারে ক্রিকেটারদের নিয়ে আসতে। শ্যামসুন্দর মিত্র থেকে শুরু করে প্রণব নন্দী, প্রকাশ পোদ্দার থেকে উদয়ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় দশ জন প্রাক্তন অধিনায়ককে (বারো জনের আসার কথা ছিল, চুনী গোস্বামী এবং প্রণব রায় আসতে পারেননি।) সোমবার একসঙ্গে বসিয়ে ব্যাটে তাঁদের সই করিয়ে নেওয়া হল। যে ব্যাট আজ দেওয়া হবে লক্ষ্মীকে, দেবেন ’৯০-এর রঞ্জি জয়ী অধিনায়ক সম্বরণ এবং কোচ পলাশ নন্দী। স্লোগান তৈরিও শেষ‘ধোনি নয়, এ বার লক্ষ্মীর জন্য!’ মানে, এ বার আর ভারত নয়। বাংলার জন্য আপনারা আসুন।
সব ঠিক আছে। রঞ্জি কোয়ার্টার ফাইনালকে ঘিরে শেষ কবে এমন চর্তুদিকে উৎসবের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, স্মৃতি হাতড়াতে হবে। রঞ্জি ট্রফি ম্যাচকে আকর্ষণীয় করতে এত চেষ্টাও সাম্প্রতিকে দেখা যায়নি। কিন্তু তার পরেও প্রশ্ন উঠে পড়ল। |
এক মঞ্চে প্রাক্তন বাংলা অধিনায়করা। (বাঁ দিক থেকে) রাজু মুখোপাধ্যায়, গোপাল বসু,
শ্যামসুন্দর মিত্র, প্রকাশ পোদ্দার, সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, পলাশ নন্দী, দেবাঙ্গ গাঁধী, উদয়ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়,
প্রণব নন্দী এবং গৌতম সোম (জুনিয়র)। সঙ্গে লক্ষ্মীর টিমের জন্য তাঁদের শুভেচ্ছা উপহার
সই করা ব্যাট। সোমবার সিএবি-তে। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস। |
প্রথমত, সোমবারের অনুষ্ঠানে দশ জন প্রাক্তন বাংলা অধিনায়ক ছিলেন, কিন্তু বর্তমান বাংলা টিমের সঙ্গে একজনেরও দেখা হল না! অধিনায়ক না, কোচ না, কেউ না। ’৮৯-’৯০-এর রঞ্জি ফাইনালের আগের রাতে পি কে বন্দ্যোপাধ্যায় এসে বাংলার ক্রিকেট টিমকে ভোকাল টনিক দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু এখানে টোটকা প্রাক্তনরা দেবেন কাকে? ব্যাট সই ও সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তাঁরা চলে গেলেন। এ দিন বাংলার প্র্যাকটিস শেষেও তো ব্যাপারটা রাখা যেতে পারত। সিএবি-র যুক্তি, সম্ভব ছিল না। সোমবার প্র্যাকটিসের পর ক্রিকেটারদের অ্যান্টি ডোপিং ও অ্যান্টি কোরাপশনের ক্লাস ছিল। তাঁরা ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। তবে মেনে নেওয়া হচ্ছে যে, একেবারে শেষ মুহূর্তে প্ল্যানটা করা হয়েছে। আগে ভাবলে, বিভ্রাট এড়ানো যেত। আর দ্বিতীয়ত, স্থানীয় ক্রিকেটমহলের একটা অংশ থেকে বলা হচ্ছে যে, বাংলার ম্যাচ নিয়ে এত দিন সামান্য আড়ম্বরও দেখা যেত না। সেখানে আচমকা কোয়ার্টার ফাইনাল নিয়ে এমন প্রবল হইচই ‘ব্যুমেরাং’ না হয়ে দাঁড়ায়। ক্রিকেটারদের উপর তো রাতারাতি বাড়তি চাপ তৈরি হয়ে গেল।
একে কোয়ার্টার ফাইনাল, তার উপর রেলওয়েজ। চাপ এমনিই একটা আছে। দিল্লিতে সন্দীপন দাসকে ‘মানকাডেড’ করে রেল ক্যাপ্টেন কার্তিকের আউট করা এবং সেটাকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের তীব্র অশান্তিখুব পুরনো হয়নি। বাংলা ড্রেসিংরুমে বলে দেওয়া হয়েছে, রেল ক্রিকেটারদের সঙ্গে ঝামেলা নিয়ে মুখ খোলা একদম নয়। মাঠে রেল ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথাই না বললে সবচেয়ে ভাল। সোজা বাংলায় মাঠে নেমে এমন আচরণ করো যেন ‘অদৃশ্য’ কোনও প্রতিপক্ষের সঙ্গে খেলতে হচ্ছে। কার্তিকদের অবস্থা আবার শোনা গেল বেশ সঙ্গীন। শহরে ঢুকলেন নির্ধারিত সময়ের বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে, প্রায় বিকেলে। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা ইডেনে ঢুকে পিচ দর্শন। বিতর্কেও জড়িয়ে পড়লেন একই সঙ্গে। সোমবার দু’টো টিমেরই অ্যান্টি ডোপিং এবং অ্যান্টি কোরাপশন নিয়ে নির্ধারিত ক্লাস ছিল। বাংলারটা দুপুরেই হয়ে যায়। তার পর রেলের জন্য বসেছিলেন কর্তারা। কিন্তু রেল ক্রিকেটাররা ইডেনে ঢুকেই শোনা গেল বলে দেন যে, তাঁরা অত্যন্ত ক্লান্ত। ইডেনে কোনও ক্লাস-টাস করতে পারবেন না। টিম হোটেলে হলে হবে। কিন্তু সেখানে আবার আলাদা ঘরের বন্দোবস্ত করা যায়নি। সেটা হবে আজ, মঙ্গলবার। শোনা গেল, বোর্ড নির্দেশিত কর্মকাণ্ডে রেল ক্রিকেটারদের এমন ঢিলেঢালা মনোভাব মোটেও পছন্দ হয়নি সংশ্লিষ্ট অফিশিয়ালদের। |
শত্রু নম্বর ১
ইডেন পরিদর্শনে মুরলী কার্তিক।—নিজস্ব চিত্র। |
রেল ক্রিকেটারদের যথেচ্ছ কথা বলাও নাকি বন্ধ। সাংবাদিকদের দেখে কাউকে কাউকে আতঙ্কিত গলায় বলতে শোনা গেল, “না, না এই ম্যাচে কোনও কথা নয়। রেল বোর্ড থেকে অর্ডার আছে। মুখ খুললে চাকরি যেতে পারে!”
চোরাগোপ্তা আক্রমণ কি তা বলে নেই? আছে। প্র্যাকটিসের পর ঋদ্ধিমান সাহা বলছিলেন, “মাঠে যা হয়, মাঠেই সেটা শেষ হয়ে যায়। বরং আমরা চাইছি, অরিন্দম ঘোষকে দ্রুত আউট করতে।” কিন্তু ওরই প্রায় কাছাকাছি সময়ে টিমের পক্ষ থেকে শুনিয়ে যাওয়া হল যে, রেল টিমে আর যা-ই হোক, বড় কোনও তারকা ক্রিকেটার নেই! অথবা, বাংলার সংসারে যে একাত্মবোধটা আছে ক্রিকেটারদের মধ্যে, সেটা রেলে কোনও দিন হওয়া সম্ভব নয়। কারণ ওটা অফিস টিম।
এবং বাংলা কতটা তেতে আছে, বুঝতে বোধহয় অশোক দিন্দার ক্ষুধার্ত মন্তব্যটাই যথেষ্ট। “রেলের যা সম্মান প্রাপ্য, ওরা পাবে। কিন্তু আমরা যে কাউকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে দেব এখন। মনে রাখবেন, ইডেনের এই উইকেটে আমি উত্তরপ্রদেশের বিরুদ্ধে ভাল বল করেছি। আমরা চার্জড।” সুখের কথা, রেল-যুদ্ধেও ইডেনের উইকেট খুব পাল্টাচ্ছে না। উত্তরপ্রদেশ ম্যাচের পিচই থাকছে। সবুজ পিচ, মানে গ্রিন টপ। |
পুরনো খবর: বাংলাকে জেতাতে আসরে প্রাক্তন অধিনায়করাও |
|
|
|
|
|