প্রবন্ধ ২...
সাধারণ মানুষ কিন্তু ঠিক বুঝিয়ে ছাড়বেন
নকল্যাণের নামে আন্দোলন ও উদ্যোগ সীমিত থাকে এই সব সুযোগসুবিধা আদায়ের মধ্যেই। সত্যিকারের কণ্ঠস্বরহীন বঞ্চিতরা সেই তিমিরেই থেকে যান।
জয়ন্ত ঘোষালের সুভদ্র অনুরোধে (‘সমস্যার নাম রাজনীতি’, ১৮-১২) কথোপকথনটি চালু রাখতেই হয় এই আশায় যে, যোগ্যতর জনেরা এতে যোগ দিয়ে গণপরিসরে এই আলোচনাটিকে সমৃদ্ধ করবেন। ২০১৩-র ফেব্রুয়ারি মাসে ‘কলকাতা লিটারারি মিট ২০১৩’-য় একটি প্রকাশ্য আলোচনায় বসেছিলেন শর্মিলা ঠাকুর এবং অমর্ত্য সেন। বিষয়: বর্তমান ভারত সম্পর্কে অমর্ত্য সেনের মতামত। প্রেক্ষিতটি ছিল জঁ দ্রেজের সঙ্গে যৌথ ভাবে লেখা বই: ‘অ্যান আনসার্টেন গ্লোরি: ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইটস কনট্রাডিকশনস’। আর্থিক বৃদ্ধির সুফল ঠিক ভাবে কাজে লাগাতে না পারার অক্ষমতার কথা দিয়েই আলোচনা শুরু করেন শর্মিলা। অমর্ত্য বলেছিলেন, আমাদের ‘দরিদ্র জনগণ’-এর ধারণাটাতেই গলদ আছে। সাধারণত দরিদ্র মানুষের প্রয়োজন বলতে সমাজের সেই স্তরটির দাবিই অগ্রাধিকার পায়, যাঁরা সুবিধাভোগীদের মধ্যে দরিদ্রতর। এ দেশে সীমাবদ্ধ সরকারি বিনিয়োগের বেশির ভাগটাই এই শ্রেণি কুক্ষিগত করায় যাঁরা বরাবর সুবিধা-বৃত্তের বাইরে, সেই বড় গোষ্ঠীটি বঞ্চিতই থেকে গেছেন। পেট্রল-ডিজেল, রান্নার গ্যাস, সার, বিদ্যুৎ, এ সবের ওপর ভর্তুকি, রত্নালঙ্কার আমদানিতে কর-ছাড়, এগুলো থেকে বঞ্চিত গোষ্ঠীটির কোনও উপকার হয় না, উপকৃত হন জনসংখ্যার উচ্চতম এক-পঞ্চমাংশ। কিন্তু বাম দলগুলি এবং কংগ্রেস তাদের আন্দোলন ও উদ্যোগ সীমিত রাখে এই সব সুযোগসুবিধা আদায়ের মধ্যেই, তার ফলে কণ্ঠস্বরহীন বঞ্চিতরা সেই তিমিরেই থেকে যান। তাঁদের উঠিয়ে আনতে যে অতিরিক্ত বিনিয়োগ প্রয়োজন সেটা হয় না। মানব উন্নয়নের নানা সূচকের নিরিখে কত দিনের মধ্যে ভারত উন্নত দেশগুলির সমকক্ষ হবে, এ প্রশ্নের উত্তরে তাঁর মন্তব্য ছিল, ঠিক পথে চললে খুব সময় লাগবে না, কিন্তু দেশ ঠিক পথে চলছে কোথায়?
২০১৩-এর জুলাই মাসে এখানে প্রকাশিত ‘অ্যান আনসার্টেন গ্লোরি’র শুরুতেই প্রশংসিত হয়েছে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সাফল্য। বৃদ্ধির উদ্যোগ অব্যাহত রাখার কথাও বলা হয়েছে। তার পরই লেখকরা প্রশ্ন তুলেছেন, এই বৃদ্ধি থেকে কে উপকৃত হল? হাসিম শেখ বা রামা কৈবর্ত বৃদ্ধি থেকে কী পেলেন? ১৯৯০ থেকে ২০১১, যে কালপর্ব বৃদ্ধির দুই দশক বলে চিহ্নিত হয়, ঠিক সেই সময়েই অন্যান্য নানা দেশ মানব উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। বৃদ্ধির ক্ষেত্রে চিন, ব্রাজিল, রাশিয়ার সঙ্গে একাসনে স্বীকৃত হলেও মানবোন্নয়নে আমরা অনেক পিছনে। ১৯৯০-তে মানব উন্নয়নের বিভিন্ন মাপকাঠিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের স্থান ছিল সাধারণত দ্বিতীয়; শ্রীলঙ্কার পরেই। এখন অনেক বিষয়েই আমরা কেবল পাকিস্তানের ওপরে। নীচ থেকে দ্বিতীয়।
ক্ষেত্রভিত্তিক বিস্তৃত আলোচনা করে অমর্ত্য সেন ও জঁ দ্রেজ বিশ্লেষণ করেছেন ভারতের পিছিয়ে পড়ার কারণ। যে সব সরকারি পরিষেবা অবস্থার পরিবর্তন করতে পারত, সেগুলি যথেষ্ট বিনিয়োগের অভাবে ধুঁকছে। গত কুড়ি বছর ধরে প্রকৃত মজুরি অপরিবর্তিত। ছেলেমেয়েদের স্কুলে আসা বাড়লেও শিক্ষার গুণগত মান বেশ খারাপ। স্বাস্থ্য পরিষেবা সর্বজনীন না হওয়ায় জনসাধারণ নির্ভর করেন সন্দেহজনক মানের বেসরকারি ব্যবস্থার ওপর, যা ক্রমশই স্বাস্থ্য খাতে মানুষের নিজস্ব খরচ বাড়িয়ে তুলছে; টিকাকরণ সার্বিক না হওয়ার দরুন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ছে না; দেশে ৪৮ শতাংশ মানুষ এখনও খোলা জায়গায় পায়খানা করেন। অর্থাভাবের যুক্তি টেকে না। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, (বিভিন্ন ভর্তুকি, কর-ছাড় ইত্যাদির ফলে) ছেড়ে-দেওয়া সরকারি আয়ের অঙ্ক ২০১০-১১’য় ৪,৮০,০০০ কোটি টাকা, আর ২০১১-১২’য় ৫,৩০,০০০ কোটি টাকা (মোট জাতীয় উৎপাদনের ৫ শতাংশ)। তথাকথিত জনসম্মোহনী নীতির ‘জন’ হচ্ছে উচ্চতম ২০ শতাংশ। গ্রন্থকারদের মতে, এই শ্রেণিটি বৃদ্ধির সুফলের বেশির ভাগটাই ভোগ করছেন, এই সব ছাড় থেকেও তাঁরাই উপকৃত হচ্ছেন। সত্য এই যে, দেশের বড় অংশটার স্ব-ক্ষমতা এবং সক্ষমতা না বাড়লে আমাদের কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক বৃদ্ধিও ব্যাহত হতে বাধ্য।
সরকারি পরিষেবায় বিনিয়োগের এই বৈষম্যের দায় বর্তায় এই দু’দশকে যাঁরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন, তাঁদের ওপর। হিসেব মতো এই কালপর্বের বেশির ভাগ সময়েই দেশ শাসনের দায় ছিল কংগ্রেস বা ইউপিএ-র। কিছু সময় বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ-ও রাজত্ব করেছে। দু’পক্ষের কেউই বিনিয়োগের বিন্যাস পাল্টাতে খুব সচেষ্ট হয়নি। সংবাদমাধ্যমগুলিও এ সব বিষয়ে বিশেষ উৎসাহ দেখায়নি। ২০১২ সালের শেষ ছ’মাসে বড় জাতীয় দৈনিকগুলির সম্পাদকীয়ের বিষয় বিশ্লেষণ করে তাঁরা দেখছেন, মাত্র ১ শতাংশ ছিল স্বাস্থ্য-বিষয়ক।
অতএব, ইউ পি এ সরকার অমর্ত্য সেনের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেছেন, এ স্বীকৃতি অন্তত তাঁদের লেখায় পাচ্ছি না। জয়ন্তবাবু ঠিকই বলেছেন, বিতর্কটি অতি সরলীকৃত। জগদীশ ভগবতী ও অরবিন্দ পানাগারিয়ার লেখা ‘ইন্ডিয়া’স ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি’ প্রকাশিত হয় ২০১২’য়। ‘আনসার্টেন গ্লোরি’র কিছু আগে। তাঁদের মতে সংস্কারের কাজটা এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কার এগোবে দু’টি আলাদা ধারায়। প্রথম ধারার অন্তর্ভুক্ত হবে শ্রম সংক্রান্ত আইনগুলির সংস্কার (যাতে নিয়োগ ও ছাঁটাই প্রক্রিয়া জটিলতামুক্ত হয়), উৎপাদনের জন্য জমি সহজলভ্য করা, উচ্চ এবং কারিগরি শিক্ষার বেসরকারিকরণ, পরিকাঠামোর উন্নতি ইত্যাদি। দ্বিতীয় ধারায় থাকবে সামাজিক পরিষেবা। কিন্তু এঁরা সর্বজনীন সামাজিক পরিষেবায় আস্থা রাখেন না, উপভোক্তার নির্দিষ্টকরণ করা জরুরি মনে করেন। সরকারি ব্যবস্থাপনায় নয়, বেসরকারি পরিষেবা ব্যবস্থায় বিশ্বাসী। বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট সংস্কারে মন না দিয়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা ইত্যাদির সর্বজনীন ব্যবস্থা করতে অর্থ ব্যয় করা অপচয় বলে মনে করেন। ভগবতী পানাগারিয়ার প্রস্তাবিত ব্যবস্থাপনার যে বিষয়গুলো নিয়ে তাঁরা সহমত নন, আলাদা ভাবে নাম না করেই, সেন দ্রেজ তার ব্যাখ্যা রেখেছেন তাঁদের বইতে। অমর্ত্য সেন মানে কংগ্রেস, আর ভগবতী মানে বিজেপি এই সরল সমীকরণ বাস্তবে প্রয়োগ করলে অনেক সময়ে মেলে না। (সেন দ্রেজ সমালোচিত) স্বাস্থ্য পরিষেবার বেসরকারিকরণের উদ্যোগে কি ভগবতীর প্রভাব? বিজেপি শাসিত ছত্তীসগঢ় অনেক আগেই খাদ্য নিরাপত্তার উদ্যোগ নিয়েছে, আর মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শপথ নিয়েই ঘোষণা করেছেন যে, তিনি এক টাকা কিলো দরের চালের ব্যবস্থা করবেন, কন্যাশিশু সুরক্ষার আলাদা কর্মসূচি চালু করবেন। এ সব তো অমর্ত্য সেন করতে বলেন। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বিশাল অর্থব্যয় তিনি কেন সমর্থন করেন, জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ভর্তুকি দেওয়া তেলে চলা গাড়িতে চেপে এসে, ভর্তুকি পাওয়া বিদ্যুতে চলা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে, ভর্তুকি দেওয়া গ্যাসে তৈরি কফি খেতে খেতে আমরা কোন মুখে বলব যে গরিব মানুষদের খাবারে ভর্তুকির প্রয়োজন নেই?
দ্রেজ-সেনের বইয়ের শেষ অধ্যায়: ‘অধৈর্য হওয়ার প্রয়োজনীয়তা’। রাজনৈতিক দলগুলি তা উপলব্ধি করছেন কি না জানি না, তবে সাধারণ মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই বুঝতে শুরু করেছেন। আমরা না বুঝতে চাইলে তাঁরা ঠিক বুঝিয়ে ছাড়বেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.