বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের নির্বাচনে প্রত্যাশিত ভাবেই শাসক দল আওয়ামি লিগ জয়ী। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইতিপূর্বেই দেড় শতাধিক আসনে লিগ প্রার্থীরা জয়ী হন। রবিবারের নির্বাচনে যে ১৪৭টি আসনে ভোটগ্রহণ হয়, তাহার মধ্যেও ১১২টিতেই লিগ সফল। বিরোধী দল বিএনপি-র বয়কটের কারণেই লিগ প্রার্থীরা এ ভাবে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে পারিয়াছেন। বিরোধীদের বয়কটের জন্য নির্বাচনের বৈধতা লইয়া প্রশ্ন উঠিতেছে। জাতীয় সংসদ যে কার্যত বিরোধী-শূন্য, তাহার উল্লেখ করিয়া সংসদের গণতান্ত্রিক বিশ্বাসযোগ্যতা লইয়াও কোনও কোনও মহলে সংশয় ব্যক্ত হইতেছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, পরিস্থিতির এই বঙ্কিম গতির জন্য শাসক দল আওয়ামি লিগ কিংবা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদকে দায়ী করা যায় না। দেশের সংসদীয় মঞ্চকে বিরোধী-শূন্য করিয়া তোলার দায় বহুলাংশে বিরোধী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার। এই নির্বাচন বানচাল করিতে বিরোধী দল বিএনপি এবং তাহার সহযোগী জামাতে ইসলামি প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াছে। নাশকতা, অচলাবস্থা সৃষ্টি, স্বাভাবিক জনজীবন ধারাবাহিক ভাবে বিপর্যস্ত করা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুঠতরাজ, রেল-লাইন উপড়াইয়া দেওয়া, শাসক দলের সমর্থক ও পুলিশের সহিত সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া মারফত বিরুদ্ধবাদীরা সমগ্র দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করিয়াছে। ভোটগ্রহণের দিনেও বুথগুলিতে অগ্নিসংযোগ, ভোটারদের সন্ত্রস্ত করিয়া বিতাড়িত করার মতো অগণতান্ত্রিক অপকর্মও দেখা যায়। নির্বাচন তথাপি বানচাল করা যায় নাই।
শাসক দল আওয়ামি লিগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে বিরোধীদের মতামত ও বক্তব্য শুনিতে চাহেন নাই, এমন নয়। তিনি বিরোধী নেত্রী খালেদার সহিত বৈঠক করিয়াছেন। রাষ্ট্রপুঞ্জের দৌত্য ও মধ্যস্থতা শিরোধার্য করিয়া একাধিক বার বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি নমনীয়তা দেখাইয়াছেন। নির্বাচনী প্রক্রিয়া হইতে সরিয়া না-দাঁড়াইতে বিরোধী নেত্রীকে অনুনয় করিয়াছেন। তাহার পরেও অভিযোগ উঠিতে পারে যে, তিনি আরও চেষ্টা করিতে পারিতেন। কিন্তু ভোট বয়কট তো তাহার উত্তর হইতে পারে না। প্রধানমন্ত্রীর ইস্তফা এবং তদারকি সরকারের অধীনে ভোট অনুষ্ঠানের আবদারে অনড় বিরোধী নেত্রী কোনও কথাই শুনিতে চাহেন নাই। উপরন্তু জামাতে ইসলামির সহিত যৌথ ভাবে উপর্যুপরি হরতাল-ধর্মঘট সংগঠিত করিয়া তাঁহার দল দেশব্যাপী যে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিয়াছে, তাহার ধারাবাহিকতা হিসাবেই যেন ভোট-বয়কটের সিদ্ধান্ত।
দুর্ভাগ্যজনক এবং অনভিপ্রেত হইলেও তাই বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন এ বার একতরফা হইয়া গেল। বিগত পাঁচ বৎসর ধরিয়া বিএনপি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ হইতে যে-ভাবে বিরত থাকিয়াছে, রবিবারের নির্বাচন বয়কটকে তাহারই অনিবার্য উপসংহার বলিয়া গণ্য করিতে হইবে। দুঃখের বিষয় হইল, জামাতিদের সাহায্য লইতে যাইয়া বেগম খালেদা জিয়া তাঁহার দলকে কার্যত ওই মৌলবাদী সংগঠনের অনুগামীতে পরিণত করিতেছেন। জামাতিরা কেবল ইসলামি মৌলবাদ ও জেহাদের অনুকূল শক্তিই নয়, বাংলাদেশের নির্দিষ্ট প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধশক্তিও। তাহার সহিত আঁতাত গড়ার দায় ঐতিহাসিক ভাবে বেগম জিয়ার উপরেই বর্তাইবে। এবং, তাহার পরিণাম তাঁহার দলের পক্ষেও শুভ হইবে বলিয়া মনে হয় না। |