লোকসভা-বিধানসভায় আগেই ভরাডুবি হয়েছিল। পাঁচ মাস আগেই পঞ্চায়েত ভোটে প্রথম বার হাতছাড়া হয়েছে জেলাপরিষদও। এমনই এক ‘পরিবর্তিত’ বীরভূমে বামফ্রন্টের ডাকা জনসভায় ভিড় দেখে রীতিমতো উজ্জীবিত জেলার বাম দলগুলির নেতা-কর্মীরা।
সোমবার সিউড়িতে জেলা স্কুলের মাঠের ওই জনসভায় উৎসাহী কর্মী-সমর্থককে দেখে আপ্লুত রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও। এ দিন বিকেল তিনটে থেকে টানা এক ঘণ্টা বক্তব্য রাখেন সূর্যকান্তবাবু। প্রথমেই জনতাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেন, “আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। বাস ধর্মঘট। ‘বিশেষ ধর্মঘট’। বোলপুর মহকুমা থেকে আবার এই জনসভায় আসার জন্য বাস পাওয়া যাবে না। এত কিছু উপেক্ষা করেও আপনারা এই সভায় এসেছেন।” তাঁর সংযোজন, “দিদিমণি ক্ষমতায় এসেই বলেছিলেন, দশ বছর মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে চুপ করে বসে থাকুন। কিন্তু দশ দিনও তিনি আমাদের চুপ করাতে পারেননি। ময়দানে আমরা এখনও আছি।”
পুলিশের হিসেব, সভায় হাজার পাঁচেক মানুষ এসেছিলেন। বামেদের দাবি, ১৫-২০ হাজার। ভিড় দেখে অতি উৎসাহী সিপিএমের জেলা কমিটির এক সদস্য বলেই ফেললেন, “কোনও সন্দেহ নেই, ৯ ফেব্রুয়ারি বিগ্রেডের জনসভার আগে মানুষের এই উপস্থিতি জেলা বামফ্রন্টকে বাড়তি অক্সিজেন জোগাবে!” সভায় ছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নরেন চট্টোপাধ্যায়, সিপিআই রাজ্য নেতা মিহির বাইন, সিপিআই জেলা সম্পাদক অপূর্ব মণ্ডল, সিপিএমের জেলা সম্পাদক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায়, বোলপুরের সিপিএম সাংসদ রামচন্দ্র ডোম, আরএসপি নেতা তথা বোলপুরের প্রাক্তন বিধায়ক তপন হোড় প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন জেলার বর্ষিয়ান নেতা ব্রজমোহন মুখোপাধ্যায়। |
সিউড়িতে জেলা স্কুলের মাঠে বামফ্রন্টের জনাসভা। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়। |
দুপুরে সভার শুরুতেই শাসক দলের বিরুদ্ধে আক্রমণের সুর চড়া করেন জেলার বর্ষিয়ান সিপিএম নেতা ব্রজ মুখোপাধ্যায়। একই প্রতিফল দেখা গেল বাকি বক্তাদের কণ্ঠেও। নরেনবাবু বলেন, “তৃণমূলের চোখরাঙানি, হুমকি সব কিছু উপেক্ষা করে এত মানুষ সভায় এসেছেন। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, সরকারের ভাবমূর্তি কোথায় এসে ঠেকেছে!” তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে বামেদের বহু পার্টি অফিসে কার্যত তালা পড়ে গিয়েছে। পার্টি অফিস পোড়ানো এবং দখলে বামেরা যদিও শাসক দলকেই অভিযুক্ত করেছে। জেলাতেও তৃণমূলে নাম লেখানোর হিড়িক লেগেছে। এই পরিস্থিতিতে সূর্যকান্তবাবুর সভায় এমন ভিড়কে বামেরা কী ভাবে দেখছে? বামফ্রন্টের এক নেতার ব্যাখ্যা, “লোকসভা, বিধানসভা, ত্রিস্তর পঞ্চায়েত সবেই তৃণমূল জিতেছে। বিপর্যয়ের এমন দিনেও যাঁরা এখনও পার্টি আঁকড়ে পড়ে এই সব সভায় ভিড় জমাচ্ছেন, তাঁরাই আসল। যাঁরা দল বদলের ভিড়ে নাম লিখিয়েছেন, তারা দলের ক্ষতিই করেছেন।”
এক ঘণ্টার বক্তব্যে বিরোধী দলনেতা বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের ভূমিকার তুমুল সমালোচনা করেন। সরকারের ধান কেনা নিয়ে নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “দিদিমণি বললেন, সরকার ধান কিনবে। জুজুও দেখিয়ে দিলেন। সরকারকে ধান বিক্রির ক্ষেত্রে চাষিরা কেউ সরাসরি টাকা পাবেন না। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট-সহ নানা হ্যাঁপা আছে। বর্ধমানের এক বিধবা তো ৭ মাস ধরে ধান না পেয়ে শেষে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হলেন! বীরভূমে ধানের দাম কী চলছে এখন? আপনারা কি সঠিক দাম পাচ্ছেন? সরকার কি এখানে ধান কিনছে?” আলুর দাম বৃদ্ধির জের টেনে বলেন, “৮-৯ টাকা কেজি দরের আলু ১৭ টাকা হয়ে গেল। দিদিমণি বলে দিলেন, সরকার আলু বিক্রি করবে। দাম বেঁধে দিলেন ১৩ টাকা কেজি। আলু বিক্রি হল তৃণমূলের পার্টি অফিস থেকে। সেই আলু গড়ে আড়াইশো গ্রাম করে বাদ দিতে হল। দাম দাঁড়ালো ১৭ টাকারও বেশিতে।”
রাজ্যে দশ লক্ষ বেকারের চাকরি হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গেও মুখ্যমন্ত্রীকে কটাক্ষ করতে সূর্যকান্তবাবু। তিনি বলেন, “রাজ্যে নাকি দশ লক্ষেরও বেশি বেকার চাকরি পেয়ে গিয়েছেন। বীরভূমের মানুষের কাছে জানতে চাইব, আপনাদের মধ্যে কত জন চাকরি পেয়েছেন? সিভিক পুলিশ, গ্রামীণ পুলিশ-সহ নানা কাজের কথা বলা হচ্ছে। হঠাৎই কাজ চলে যাচ্ছে! রাজ্যে কোথাও কোনও নিশ্চয়তা নেই, নিরাপত্তা নেই।” একই সঙ্গে প্রাথমিকে নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলে সূর্যকান্তবাবু বলেন, “১৮ হাজার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পরীক্ষার্থী টেট পরীক্ষায় পাশ করেনি। ওই প্রশ্নপত্রে তৃণমূলের কোনও মন্ত্রী এমনকী, মুখ্যমন্ত্রীও পাশ করতে পারবেন না।” তাঁর সংযোজন, “সারা রাজ্যের মতো এই জেলাতেও ৭ লক্ষ টাকা বাজারদর ছিল। এমএলএ, কাউন্সিলর থেকে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের পরিবারের কারও কারও ৪-৫ জনও পাশ করে গিয়েছেন!” সভাতেই মধ্যমগ্রাম-কাণ্ডে পুলিশ-প্রশাসনের তীব্র সমালোচনা করে সূর্যবাবু ঘটনার উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের দাবি করেন।
সভার পরে দিলীপবাবু দাবি করেন, “সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ ফের আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়েছেন। মানুষ বুঝতে পারছেন, পরিবর্তনের এই সরকার কেমন। তা বুঝতে পেরেই মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যোগ দিয়েছেন।” অন্য দিকে, সূর্যবাবুর বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে চাননি জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। তিনি সাফ বলেন, “গত ৩৪ বছরে এ রাজ্যের জন্য সূর্যবাবুরা কোনও উন্নয়নই করতে পারেননি। গত আড়াই বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার তা করে দেখিয়েছে।” তাঁর দাবি, সভায় মেরেকেটে ৩ হাজার লোক হয়েছিল। |