সেটা ছিল অনাহারের আমলাশোল। আজকের আমলাশোল অনেকটাই ‘বদলে যাওয়া’।
সেই আমলাশোলে রাস্তা ছিল না। স্বাস্থ্য পরিষেবা ছিল না। রেশন ছিল না। খাবার ছিল না। ছিল না পানীয় জল। আজকের আমলাশোলে রাস্তা হয়েছে। স্বাস্থ্য পরিষেবা পাচ্ছেন সেখানকার মানুষ। পানীয় জলের বন্দোবস্ত হয়েছে। অপুষ্টি-অনাহারের সমস্যাও মিটেছে। ‘বদলে যাওয়া’ এ হেন আমলাশোলেই দশ বছর পরে পা রাখছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০০৪ সালে এসেছিলেন বিরোধী নেত্রী হিসাবে। অনাহার-ক্লিষ্ট আর্ত মানুষগুলির পাশে দাঁড়াতে। ২০১৪-য় আসছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে। কাল, মঙ্গলবার তিনি আকাশপথে আমলাশোলে আসবেন স্থানীয় মানুষের জন্য রাজ্য সরকারের তরফে একগুচ্ছ উন্নয়নমূলক পরিষেবার ডালি সঙ্গে নিয়ে।
বস্তুত, পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি ব্লকের আমলাশোলে এই প্রথম কোনও মুখ্যমন্ত্রী আসছেন। আমলাশোলকে মডেল গ্রাম-সহ বেশ কিছু ঘোষণা করতে পারেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর এই প্রথমবার সরাসরি কলকাতা থেকে হেলিকপ্টারে জঙ্গলমহলে আসছেন মমতা। তবে, নিরাপত্তা জনিত কারণে পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা আমলাশোল গ্রামে হেলিকপ্টার নামানোর ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা রয়েছে। তাই মঙ্গলবার দুপুর ১টা নাগাদ আমলাশোলের বেশ কিছুটা আগে কদমডিহা এলাকার একটি মাঠে নামবে হেলিকপ্টার। সেখান থেকে সাড়ে সাত কিলোমিটার সড়কপথে কাঁকড়াঝোর হয়ে আমলাশোলের ফুটবল মাঠে পৌঁছবেন মুখ্যমন্ত্রী। |
আমলাশোলের ফুটবল মাঠ। এখানেই মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠান।
তৈরি হচ্ছে মঞ্চ। ছবি: দেবরাজ ঘোষ। |
২০০৪ সালে আমলাশোলে অনাহার-অপুষ্টিতে পাঁচ আদিবাসীর মৃত্যু হয়েছিল। মৃতদের মধ্যে চার জনই ছিলেন শবর সম্প্রদায়ের। সেই খবর পেয়ে ওই বছর জুন মাসে আমলাশোলে ছুটে গিয়েছিলেন ‘বিরোধী নেত্রী’ মমতা। ওদলচুয়া-কাঁকড়াঝোর রাস্তাটি তখন কাঁচা ছিল। আর আমলাশোল যাওয়ার রাস্তা বলে কিছুই ছিল না। ভরা বর্ষায় জলকাদা ভেঙে সড়ক পথে সে-বার আমলাশোলে গিয়েছিলেন মমতা। ওদলচুয়ার সেই রাস্তাটি এখন কাঁকড়াঝোর পর্যন্ত পিচের হয়েছে। কিন্তু, নিরাপত্তার কারণে ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া ওদলচুয়ার পাহাড়ি পিচ রাস্তাটি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে রাজি হয়নি পুলিশ-প্রশাসন। বিকল্প ‘নিরাপদ পথ’ও নেই। ফলে, এ বার আকাশপথেই আসছেন মুখ্যমন্ত্রী।
প্রশাসনের এক সূত্রের বক্তব্য, এই পরিস্থতিতে ৭ জানুয়ারি আমলাশোলে মুখ্যমন্ত্রীর এই কর্মসূচিটি মূলত সরকারি পরিষেবা প্রদান অনুষ্ঠানের নামে ‘জনসংযোগ কর্মসূচি’ও বটে। আমলাশোল গ্রামের ফুটবল মাঠে মঞ্চ তৈরি হয়েছে। ওই মাঠে হাজার তিনেক লোক ধরে। প্রশাসন সূত্রের খবর, আমলাশোল ও জোড়ামের মতো কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের হাতে নানা ধরনের সরকারি পরিষেবা তুলে দেবেন মুখ্যমন্ত্রী। কাল মঙ্গলবার, রাজ্য জুড়ে সব গ্রাম পঞ্চায়েতে মোরাম ও ঢালাই রাস্তা তৈরির কাজ শুরু হচ্ছে। কাঁকড়াঝোর থেকে আমলাশোল যাওয়ার দু’কিমি রাস্তাটির শিলান্যাস করে (রাস্তাটি কংক্রিটের ঢালাই হবে) আমলাশোল থেকে রাজ্যব্যাপী ওই প্রকল্পের সূচনা করবেন মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের সভাধিপতি উত্তরা সিংহ বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী জঙ্গলমহলে আসা মানেই উন্নয়নের নতুন দিগন্তের সূচনা। এ বারও জঙ্গলমহলের মানুষের জন্য অনেক কিছুই অপেক্ষা করছে।”
অপেক্ষায় আমলাশোলও। অনাহার-পর্বের পর থেকে সরকারি আধিকারিক, রাজনৈতিক নেতা বা মন্ত্রীদের আনাগোনা দেখতে অভ্যন্ত আমলাশোলের মানুষ এখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না যে, মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের গ্রামে আসছেন! তাই কৌশল্যা মুড়া, মালতি শবর বা হাঁদু সিংহরা বলছেন, “মুখ্যমন্ত্রী যে আমাদের কাছে আসতে পারেন, ভাবতে পারছি না। তবে, নিরাপত্তার যা কড়াকড়ি, তাতে তাঁকে আমাদের দাবিদাওয়া বা আবেদন জানাতে পারব কি না, জানি না।” |
জঙ্গলমহলে আসছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই রবিবার মেদিনীপুর-লালগড় রাস্তায়
শালবনির ভীমপুরে চলছে সিআরপি জওয়ানদের টহলদারি।—নিজস্ব চিত্র। |
মমতা প্রায় দেড় ঘন্টা আমলাশোলে থাকবেন। বিকেলে আমলাশোল থেকে হেলিকপ্টারে ঝাড়গ্রামে যাবেন। ঝাড়গ্রাম শহরের উপকন্ঠে লোধাশুলি-ঝাড়গ্রাম রাজ্যসড়কের ধারে, বাঁদরভুলার জঙ্গলের মাঝে বন উন্নয়ন নিগমের প্রকৃতি ভ্রমণ কেন্দ্রে তাঁর রাতে থাকার কথা। রাস্তার দিকে নীল কাপড় দিয়ে প্রাচীরের মতো ঘিরে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে পথচারী ও যানবাহনগুলির আরোহীরা ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্রটি দেখতে পাবেন না। যে ঘরে মুখ্যমন্ত্রীর থাকার কথা, সেটিকেও ঢেলে সাজা হয়েছে। এরই পাশাপাশি, ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ির ট্যুরিস্ট রিসর্টটির ভিআইপি স্যুইটও প্রস্তুত রাখা হয়েছে বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে এর আগে যতবার মমতা ঝাড়গ্রামে এসেছেন, থেকেছেন রাজবাড়িতেই।
বুধবার দুপুর ১২টায় ঝাড়গ্রাম স্টেডিয়ামে এক প্রশাসনিক জনসভা করবেন মুখ্যমন্ত্রী। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, জঙ্গলমহলে ফের সক্রিয় হচ্ছে মাওবাদীরা। এক সময়ের তাদের ধাত্রীভূমি বেলপাহাড়িতে ফের তাদের আনাগোনা বেড়েছে। ঝাড়খণ্ড সীমানা দিয়ে মাঝে মধ্যেই মাওবাদীরা বেলপাহাড়ির প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে যাতায়াত শুরু করেছে। ফলে, এ বার মুখ্যমন্ত্রীর দু’দিনের সফরকে ঘিরে আমলাশোল ও ঝাড়গ্রামে অভূতপূর্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে ঝাড়গ্রাম জেলা পুলিশ-প্রশাসন। রাজ্য পুলিশের এক পদস্থ কর্তা বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর সফরকে ঘিরে সব ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
গত শুক্রবার পরীক্ষামূলক ভাবে বেলপাহাড়ি ও ঝাড়গ্রামে হেলিকপ্টার নেমেছিল। এ দিন থেকেই আমলাশোল লাগোয়া জঙ্গলে টানা ৭২ ঘন্টার জন্য সিআরপিএফ ও কাউন্টার ইনসার্জেন্সি ফোর্স (সিআইএফ) যৌথ ভাবে তল্লাশি শুরু করেছে। মঙ্গলবার ও বুধবার মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন মোট তিন হাজার পুলিশ। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পূর্ব মেদিনীপুরের মতো জেলাগুলি থেকে প্রায় দু’হাজার পুলিশকে নিয়ে আসা হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ২২ জন ডিএসপি, ১৩ জন এএসপি এবং কেন্দ্রীয় ও রাজ্য বাহিনীর ৫ জন কমান্ডিং অফিসার। |