চিডিকে জড়িয়ে ধরে নাচানাচির পরেই গোটা টিমের সঙ্গে উল্লাস। তার পর মহাশূন্যে চোখ তুলে ঈশ্বরকে খোঁজার চেষ্টা। মুখে তৃপ্তির এক অদ্ভুত হাসি! তবে ঠোঁটের কোণে লেপ্টে থাকা চওড়া হাসিটা যুবভারতীর টানেল পার করেই কেমন যেন মিইয়ে গেল! ইস্টবেঙ্গল ড্রেসিংরুমের সামনে পৌঁছতে পৌঁছতে তো একেবারেই উধাও।
কলকাতা লিগের ট্রফি প্রায় নিশ্চিত করার আনন্দে যে উচ্ছ্বসিত আর্মান্দো কোলাসোর ছবি মাঠের ভিতরে ফুটে উঠেছিল, সেটা ইউসেবিওর মৃত্যুর আচম্বিত খবরে যেন একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল। ইস্টবেঙ্গল কোচ ফের দু’চোখ তুলে ঈশ্বরকে খুঁজলেন। তবে আর আনন্দে নয়, তীব্র শোকে। “উনিশ বছর আগে ইউসেবিওর সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল। পর্তুগাল ভেটারেন্স টিমের সঙ্গে একটা ম্যাচ খেলতে এসেছিলেন গোয়ায়। পার্টিতে এক সঙ্গে দু’জনে গানও গেয়েছিলাম আমরা। ইউসেবিও আর নেই, এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না,” যুবভারতীর করিডরে দাঁড়িয়ে খুব মৃদু স্বরে বলছিলেন শোকার্ত আর্মান্দো।
ইউসেবিওর মৃত্যুকে যেমন মেনে নিতে পারছেন না, তেমনই দু’ম্যাচ বাকি থাকতেই যে কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে গিয়েছেন, সেটাও ইস্টবেঙ্গল কোচের কাছে যেন পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য নয়। অথচ গোয়ায় চার দিনের ছুটি কাটানোর প্রস্তুতি রবিবার রাত থেকেই নিতে শুরু করে দিচ্ছেন তিনি। “কোনও টিমকে ছোট করতে চাই না। আগে পরের ম্যাচটা জিতি। তার পর বলব, হ্যাঁ, আমরা চ্যাম্পিয়ন। তবে এ বার ছুটি মনে হচ্ছে পেয়ে যাব,” বলছিলেন আর্মান্দো। ময়দানের প্রথম গোয়ান কোচ বুধবারের কালীঘাট মিলন সংঘ ম্যাচ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইলেও, মোহনবাগান কোচ করিম বেঞ্চারিফা কিন্তু ছেড়েই দিয়েছেন কলকাতা লিগের আশা। রবিবার নিজের ফ্ল্যাটে বসে টিভিতে ইস্টবেঙ্গল-ইউনাইটেড ম্যাচ দেখার পর আনন্দবাজারকে বাগানের মরক্কান কোচ বললেন, “মোহনবাগান হারার জন্য মাঠে নামে না। মহমেডান ম্যাচও আমরা জিততে চাই। কিন্তু কলকাতা লিগ হয়তো আর জেতার সুযোগ নেই। তাই ওই ম্যাচে ফেড কাপের প্রস্তুতি সেরে নিতে চাই।” |
গোলের উচ্ছ্বাস
যুবভারতীতে রবিবারের চিডি। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস। |
কিন্তু ফেড কাপের আগে ইস্টবেঙ্গল কতটা প্রস্তুত, সেটা রবিবারের ম্যাচ দেখে অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেল। যে স্ট্রাইকারদের গোল নষ্টের রোগ এত দিন ঘুম কেড়ে নিয়েছিল আর্মান্দোর, সেই চিডি-মোগা নতুন আলোর সন্ধান দিলেন ইস্টবেঙ্গলে। বিরতির আগে ও পরে দু’জনে দু’টো অনবদ্য গোল করে। ইউনাইটেড ডিফেন্সের ফাঁক দিয়ে এ দিন যে সময় মাছি গলার উপায় ছিল না, ম্যাচ শুরুর তেরো মিনিটের মধ্যে সেখান দিয়েই প্রথম গোল মোগার। প্রায় পঁচিশ গজ দূর থেকে বাঁ পায়ের দুরন্ত শটে।
এবং চিডি? একাশি মিনিটে মাঠে নেমে বলে যে প্রথম টোকাটা লাগালেন, সেটাই গোল। তুলুঙ্গার পাস থেকে কাঁটা-কম্পাস মাপা শটে। চিডি বলছিলেন, “ফেড কাপের আগে গোলটা আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিল।” তবে গোল করেও অভিমান চেপে রাখতে পারলেন না মোগা। গাড়িতে ওঠার আগে ওডাফা-স্টাইলে বলে গেলেন, “কোথায় গেলেন সেই সমর্থকেরা, কিছু দিন আগে যাঁরা ‘গো ব্যাক মোগা’ বলছিলেন? মোগা চলে যাওয়ার জন্য কলকাতায় আসেনি।” মোগা গোল করলেও তাঁর দু’টো শট পোস্টে লাগে, একটা একের বিরুদ্ধে এক মিস হয়। তবু স্ট্রাইকারদের আত্মবিশ্বাস অনেকটাই চিন্তামুক্ত করবে আর্মান্দোকে।
ইস্টবেঙ্গলের স্ট্রাইকাররা ভরসা দিলেও, ইউনাইটেড কোচ এলকো সাতোরির দুশ্চিন্তা কাটাতে পারলেন না র্যান্টি মার্টিন্স। গোল করার সেই জেদটাই যেন নেই নাইজিরিয়ান গোলমেশিনের মধ্যে! না হলে ওপারা-অর্ণবহীন লাল-হলুদ ডিফেন্সকে একবারও ভাঙতে পারবেন না কেন? পায়ে বলই রাখতে পারছেন না। একবার গোলের কাছাকাছি পৌঁছলেন, সেটাও অফসাইড। এলকো অবশ্য বলছেন, “র্যান্টির দোষ নেই। ওকে পাস দেওয়ার লোক না-থাকলে, গোল করবে কী ভাবে? চ্যালেঞ্জ করে বলছি, আমার হাতে ইস্টবেঙ্গলের মতো টিম থাকলে কেউ আমাদের হারাতে পারত না।” এলকোর দুর্ভাগ্য, সেটা তো নেই-ই, উল্টে চোট-আঘাতে টিম যেন মিনি হাসপাতাল। ফেড কাপেও দলের অন্যতম বিদেশি স্ট্রাইকার এরিককে সম্ভবত পাওয়া যাবে না।
ম্যাচের পরে ড্রেসিংরুমে হঠাৎ-ই অসুস্থ হয়ে পড়েন আর্মান্দো। সাংবাদিক সম্মেলনেও আসেননি। লাল-হলুদ টিম বাস ছাড়ার পরে যখন যুবভারতীর পিছনের গেট দিয়ে তিনি বেরোচ্ছেন, তখন তাঁর হাতে মাথা-যন্ত্রণার ওষুধের শিশি। অনবরত বোলাচ্ছেন কপালে। দেখে মনে হল, খুব বেশি চিন্তার নয়। দু’এক-দিনের মধ্যেই হয়তো সেরে উঠবেন। তবে মোগার মেজাজ ‘সেরে’ না-উঠলে, কেরলের মাঞ্জেরিতে (ফেড কাপে ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের ভেনু) এ রকম ওষুধ আরও কয়েক শিশি ব্যাগে রাখতে হতে পারে ইস্টবেঙ্গল কোচকে!
ইস্টবেঙ্গল: গুরপ্রীত, নওবা, গুরবিন্দর, সৌমিক, রাজু, হরমনজ্যোৎ, ভাসুম (তুলুঙ্গা), কেভিন (লেন), লালরিন্ডিকা, মোগা (চিডি), সুয়োকা। |