ওসামা বিন লাদেন নিশ্চিহ্ন হইয়াছেন। কিন্তু তাঁহার হাতে-গড়া জেহাদি সংগঠন আল-কায়দা সমগ্র উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ায় নানা শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হইয়া দাপাইয়া বেড়াইতেছে। ইরাকের আনবার প্রদেশে ফালুজা ও রামাদি জনপদে তাহারা কার্যত সরকারি সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের সমান্তরাল সরকার গড়িতেছে। গত কয়েক দিন ধরিয়া কখনও জেহাদি জঙ্গিরা ওই দুই জনপদের দখল লইতেছে, কখনও সরকারি নিরাপত্তা রক্ষীরা। জঙ্গি, সেনা ও অসামরিক নাগরিক মিলিয়া শতাধিক ব্যক্তি ইতিমধ্যেই নিহত। কালো পোশাকে আপাদমস্তক আবৃত জেহাদিরা প্রকাশ্যেই কুচকাওয়াজ করিতেছে, মসজিদগুলির দখল লইয়া তাহাদের মাইক হইতে জনসাধারণকে সন্ত্রস্ত করিতেছে। দুই বছর আগে মার্কিন নৌসেনাদের ঘরে ফেরার পর হইতে ক্রমশ এই জেহাদিরাই হইয়া উঠিতেছে ইরাকের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়া জনসমাজের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।
লক্ষণীয়, প্রতিবেশী সিরিয়াতেও এই জেহাদিরাই ক্রমশ প্রেসিডেন্ট আসাদ-বিরোধী বিদ্রোহী বাহিনীর নেতৃত্ব কব্জা করিয়া ফেলিয়াছে। ফলে বিদ্রোহীদের আর তত স্বৈরাচারবিরোধী এবং গণতন্ত্রপ্রেমী বলিয়া প্রচার করাও পাশ্চাত্যের পক্ষে উত্তরোত্তর কঠিন হইতেছে। আল-কায়দা যে তালিবানের মতোই প্রতিক্রিয়ার শক্তি, ইসলামি ধর্মান্ধতা ও উগ্র অসহিষ্ণুতার পৃষ্ঠপোষক, এ কথা কাহারও অজানা নয়। সেই আল-কায়দা যদি কোনও আন্দোলনকে ভিতর হইতে দখল করিয়া লয়, তবে সেই আন্দোলনকে সমর্থন করা ঝুঁকির কাজ হইয়া পড়ে। আসাদ-জমানার উত্খাতে নিয়োজিত বিদ্রোহীদের প্রতি নৈতিক ও সামরিক সমর্থন জুগাইয়া যাওয়া তাই আমেরিকা ও পশ্চিমের পক্ষে আত্মখণ্ডনের মতো। ইরাক ও সিরিয়াকে একটি অভিন্ন ইসলামি রাষ্ট্রে বদ্ধ করার অঙ্গীকার লইয়া যে-জেহাদিরা পশ্চিম এশিয়ায় অশনি-সংকেত ছড়াইতেছে, লেবাননেও তাহারাই প্রভাব বিস্তার করিতেছে। এই সুন্নি জেহাদিদের নিয়ন্ত্রণ করিতে কিংবা তাহাদের পাল্টা চাপে রাখিতে তাই ইরান ও ইরাকের শিয়া ইসলামকে সমর্থন করাই পশ্চিমের রণকৌশল হওয়া উচিত। সেই রণকৌশলের মধ্যে একটি প্রায়শ্চিত্তের উপাদানও রহিয়াছে।
সাদ্দাম হুসেন পরমাণু ও জৈব-রাসায়নিক মারণাস্ত্র মজুত করিতেছেন, এই ভুয়া অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘ন্যাটো’ জোটের ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে লইয়া ইরাককে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করিয়াছিল। ‘সাদ্দাম স্বৈরাচার’-এর সেই ধ্বংসস্তূপ হইতেই শিয়া গরিষ্ঠতার ইরাকে সুন্নি জেহাদি আল-কায়দার বিকাশ। সাদ্দাম-বিযুক্ত ইরাকে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি এবং সেই অবসরে আল-কায়দার বিস্তারের দায় তাই একান্ত ভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। লিবিয়াকেও মোয়াম্মের গদ্দাফির স্বৈরাচার হইতে মুক্ত করিতে গিয়া পশ্চিমী অত্যুত্সাহীরা অনুরূপ শূন্যতার জন্ম দিয়াছে, যাহা এখন জেহাদি ইসলামের উর্বর সূতিকাগার। আর সিরিয়ায় আসাদ-জমানার বদল ঘটাইবার বাসনায় বিদ্রোহীদের অস্ত্রে ও রসদে মদত দিতে গিয়া সেই জেহাদিদের হাতই শক্ত করা হইয়াছে, রুশ-অধিকৃত আফগানিস্তানে মুজাহিদদের একদা যে ভাবে অস্ত্রসজ্জিত করা হইয়াছিল। পরবর্তী কালে তালিবান জেহাদিরা সেই মুজাহিদিন অস্ত্র-সম্ভারের দখল লয়। এখন আল-কায়দার জঙ্গি ঘাতকরা জেহাদি ইসলামের প্রসার ঘটাইবার নামে সিরিয়া ও ইরাককে একটি হরিত্ নিশানের তলায় সমবেত করিতে ব্যগ্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলির দায়িত্ব এই অভিযান প্রতিরোধ করা। |