কিংবদন্তি সংগীতকার, ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত পণ্ডিত রবিশঙ্করের প্রয়াণের এক বছর পূর্তিতে শঙ্করলাল ভট্টাচার্যের স্মৃতিচারণ ‘অস্তাচলের বারো মাস’ (১৪-১২) অনবদ্য, সময়োচিত ও যথার্থ। শঙ্করলালবাবু এই অমর মানুষটির সম্পর্কে নানা তথ্য দিয়ে অনেক অজানা দিক উন্মোচিত করেছেন। দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণী মন্দির নিয়ে ‘দক্ষিণেশ্বরী’ রাগবিন্যাসের মাধ্যমে উজাড় করে দিতে চেয়েছিলেন শিল্পী তাঁর সংগীতের ভাণ্ডার। সেই অপূর্ণ সাধের কথা লেখক বেদনাহত চিত্তে ব্যক্ত করেছেন। জীবনের অন্তিম পর্যায় পর্যন্ত রাগিণীর সেই নৈপুণ্যের কোনও পরিচয় দেননি তিনি। তা জানার সুযোগও আজ আর নেই। তবে এই দক্ষিণেশ্বর মন্দিরেই এক ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে তিনি তাঁর সংগীত প্রতিভার বিরল নিদর্শন রেখে গেছেন। |
১৯৮৫ সাল। শ্রীচৈতন্যদেবের ৫০০ তম আবির্ভাব বর্ষ। স্বামী শিবানন্দ গিরি মহারাজের পরিচালনায় সে বার মহাপ্রভুর জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে মন্দির চত্বরেই শুরু হয়েছিল ‘নিখিল বঙ্গ ভক্তিগীতি সম্মেলন’। ২৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠানে এলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। প্রথমে মন্দিরে গিয়ে তিনি প্রণত হয়ে ‘ভক্তজনকল্পবল্লী’ ভবতারিণী মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন। সে এক বিরাট উত্সাহ ও আলোড়ন। মন্দির প্রাঙ্গণে সুবিশাল মঞ্চে এসে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে স্মরণ করে তাঁর উদ্দেশে রাগ গাঁথলেন ‘অস্পৃশ্যতা দূর হোক’। সে দিন পণ্ডিতজি পরিণত হয়েছিলেন সম্পূর্ণ এক অন্য মানুষে। গলায় তাঁর মালা, কপালে সিঁদুরের তিলক আর চন্দনের টিপ। শুধু জনপ্রিয়তায় নয়, তানের ঝর্নাধারায়, সুরের খেলায় ধামার চৌতাল-তেওড়া-সহ ধ্রুপদ অঙ্গের বাজনায় শান্ত সমাহিত মুগ্ধ শ্রোতা। দ্বাদশ শিবমন্দিরের গায়ে, নাটমন্দিরে, গঙ্গার ঘাটে, নৌকোয় চার দিকে শ্রোতার ঢল। রবিশঙ্করজি সেই মুগ্ধ জনতাকে নমস্কার করে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, ‘আমার জীবনে এক নতুন অভিজ্ঞতা। এত বড় শ্রোতৃমণ্ডলী আর পাইনি’। কলকাতার এক দৈনিক পত্রিকা লিখল, ‘কুষ্ঠরোগী কম্বল মুড়ি দিয়ে বাজনা শুনছেন। মায়ের মন্দিরে অবারিত দ্বার নইলে ওদের কে ঢুকতে দেবে রবিশঙ্করের অভিজাত সুরের আসরে?’ সেই ভক্তিগীতি সম্মেলনের অনুষ্ঠানে নিজেকে সে দিন সক্রিয় ভাবে যুক্ত রাখার জন্য রবিশঙ্করজিকে খুব কাছ থেকে দেখার ও তাঁর সঙ্গে দু-একটি কথা বলার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব বারবার বলতেন, ‘চৈতন্য এবং কালী এক। এটা জানলে জ্ঞান পূর্ণ হয়।’ সুরধুনীর তীরে সবধর্মসমন্বয়ের মহাতীর্থ দক্ষিণেশ্বরে সে দিন বিশ্ববরেণ্য এই শিল্পীর মার্গসংগীতের সজীবতায় সুরের ইন্দ্রজাল রচনা ঠাকুরের সেই বাণীরই অনুবর্তন।
চৈতন্যময় নন্দ। মুগবেড়িয়া, পূর্ব মেদিনীপুর
|
নন্দিনী ভৌমিক ও রুমা রায়ের দ্বারা পৌরোহিত্যের কথা ‘সাবেকিয়ানা মেনেও বিয়ে দিচ্ছেন নন্দিনীরা’ (১১-১২) পড়ে আনন্দিত হলাম। আরও আনন্দিত হলাম পরম শ্রদ্ধেয়া সারদা মিশনের সন্ন্যাসিনীরা এবং অধ্যাপক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী এটা সমর্থন করেছেন জেনে। অবশ্য হিমাংশু স্মৃতিতীর্থ মেয়েদের প্রণব উচ্চারণে বিরোধী। একমাত্র পূর্ব ভারতের পুরোহিতরাই এ সম্বন্ধে এতটা নেতিবাচক। ভারতের অন্য অনেক স্থানেই মেয়েদের প্রণব উচ্চারণের অধিকার স্বীকৃত। হিন্দু ধর্মের দুটি সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান রামকৃষ্ণ মিশন ও চিন্ময় মিশনে মেয়েদের এই অধিকার স্বীকৃত। গায়ত্রী পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা পণ্ডিত শ্রীরাম শর্মা আচার্য পবিত্র মন্ত্রের অমৃতখনি সকলের কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য জীবন উত্সর্গ করেছিলেন। তিনি বলেছেন, জাতি, লিঙ্গ, এমনকী ধর্ম নির্বিশেষে সকলে গায়ত্রী মন্ত্র (যার শুরুই প্রণব মন্ত্রে) উচ্চারণ ও জপ করে আত্মোন্নতি করতে পারেন। সব কুসংস্কারের অবসান ও নারীর সমানাধিকারের কথা বলে তিনি অজস্র গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত গায়ত্রী পরিবারের অজস্র কেন্দ্র এই কাজে নিযুক্ত আছে।
নন্দিনী ও রুমা কন্যাদানের অংশটি বাদ দিয়েছেন। অধ্যাপক ভাদুড়ী তার বিরোধিতা করেছেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই প্রশ্ন করছি, শাস্ত্রে নানা রকম বিবাহের উল্লেখ আছে। দৈব (কন্যাদান), গন্ধর্ব (মালা বদল), রাক্ষস (কন্যাহরণ), অসুর (কন্যাক্রয়) এবং পিশাচ (মত্ততা বা নিদ্রার সুযোগ নিয়ে বিবাহ)। এর মধ্যে প্রথম দুটি সর্বাপেক্ষা শ্রদ্ধেয় ছিল এবং এর একটি করলে অন্যটির প্রয়োজন হত না। যেমন, দুষ্মন্ত ও শকুন্তলা মালা বদল করে গন্ধর্ব বিবাহ করলে কণ্ব মুনি প্রসন্ন হলেও কন্যাদানের প্রশ্ন ওঠাননি। তা হলে বিবাহে মালা বদল (গন্ধর্ব) যদি করা হয়, কন্যাদান (দৈব) না-করলে চলবে না কেন?
সুস্মিতা ভট্টাচার্য। কলকাতা-২৬
|
‘গাছ কাটা নিয়ে শুনানি হাইকোর্টে’ (২০-১২) খবরটি হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগিয়ে তুলল। নৈহাটি অঞ্চলের শতাব্দী প্রাচীন গরিফা উচ্চবিদ্যালয়ে আমি এক দশকের বেশি সময় ধরে শিক্ষকতা করছি। বিদ্যালয় চত্বরে ৮০-৯০ বছর ধরে তিনটি কৃষ্ণচূড়া গাছ ছাত্রছাত্রী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ছায়াসুশীতল শান্তি দানের পাশাপাশি সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে থাকত। হঠাত্ গ্রীষ্মাবকাশের পর স্কুলে গিয়ে চমকে উঠলাম। লাল ফুলে আলো করে থাকা এক দশকের সঙ্গী উধাও। সমূলে উত্পাটিত হয়েছে তিনটি কৃষ্ণচূড়ার একটি। কষ্টে কুঁকড়ে গেল মনটা। কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করে এই অন্তর্ধানের কোনও সঠিক কারণ জানতে পারলাম না।
শুধু কর্মক্ষেত্র নয়। আমি যে অঞ্চলে বসবাস করি, সেখানেও রাস্তা চওড়া করার নামে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে গাছ। বাইপাস সংলগ্ন কালিকাপুরে আমার বাসস্থান। রোজ স্কুলে যাওয়ার পথে বাইপাসের দু’ধারে যে গাছগুলো দেখে উজ্জীবিত হতাম, তা কেটে সাফ করে ফেলা হয়েছে। বাইপাস সম্প্রসারণের জন্য পাটুলি থেকে রুবি হাসপাতাল পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারের বড় বড় গাছ রাতারাতি কেটে ফেলা হয়েছে। শুধু কর্মক্ষেত্রে ও যাতায়াতের পথে নয়, সর্বত্র অবাধে বৃক্ষচ্ছেদন চলছে নির্বিবাদে। এ ভাবে যদি গাছ কাটা চলে, তা হলে অচিরেই পৃথিবী প্রেমেন্দ্র মিত্র বর্ণিত ‘পিঁপড়ে পুরাণ’-এর অবস্থা ধারণ করবে। তখন পিঁপড়ের মুখে পৃথিবীর অতীত ইতিহাস শোনার মতো একজন মানুষও অবশিষ্ট থাকবে না।
কমলকুমার দাশ। কলকাতা-৭৮ |