সাংসদেরা দুষছেন প্রশাসনকে
‘ইউসি’ না আসায় অমিল সাংসদ কোটার টাকা
শপুর পঞ্চায়েতে মামুদপুরের কাছে শাল নদীর উপরে ভাসাপুল। কিংবা চিনপাই পঞ্চায়েত এলাকার বিশালপুর পিরিজপুর যাতায়াতের পথে সেচ খাল। দু’টিই বাসিন্দাদের বহু দিনের দাবি। কিন্তু আজও তা পূরণ হয়নি। যদিও সাংসদ তহবিলের টাকায় প্রত্যেকটি দাবিই মেটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এলাকার সংশ্লিষ্ট সাংসদ। কিন্তু অভিযোগ, প্রশাসনিক তরফে আগের কাজের জন্যই প্রয়োজনীয় ‘ইউসি’ (ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট) না মেলায় সাংসদ প্রস্তাবিত এমনই অনেক কাজ বাস্তবায়িত হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। তৃণমূলের শতাব্দী রায় এবং সিপিএমের রামচন্দ্র ডোম কার্যত জেলার দুই সাংসদেরই ইঙ্গিত, ইউসি না মেলার পেছনে রয়েছে প্রশাসনিক ঢিলেমি। তার জেরেই পরের ধাপের প্রাপ্য টাকা মিলছে না। এ দিকে, সামনেই লোকসভা ভোট। কিন্তু সাধারণ মানুষের ওই দাবিগুলি কবে পূরণ হবে, তা নিয়েই সংশয় তৈরি হয়েছে।
বীরভূম কেন্দ্রের সাংসদ শতাব্দী রায় জানিয়েছেন, তাঁর সাংসদ কোটায় ২০১২-১৩ অর্থ বর্ষের শেষ কিস্তি এবং ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষের প্রথম কিস্তি মিলিয়ে মোট ৫ কোটি টাকা বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দ করা হয়েছিল। কিন্তু ওই বরাদ্দের বহু কাজের ইউসি এখনও মেলেনি। শতাব্দী বলছেন, “যত ক্ষণ না আগের বরাদ্দের ইউসি পাওয়া যাচ্ছে, তত ক্ষণ বাকি আড়াই কোটি টাকা পাব না। সামনেই আবার লোকসভা ভোট। ভোটের দিন ঘোষণা হওয়ার আগে ইউসি না পেলে দুবরাজপুরে জন্য তিনটি সেতু এবং জেলার দু’টি থানা এলাকার উন্নয়নের জন্য যে সমস্ত পরিকল্পনা নিয়েছিলাম, তা বাস্তবায়িত করতে প্রয়োজনীয় টাকা জোগাড় হবে বলে মনে হচ্ছে না।”
অন্য দিকে, বোলপুর কেন্দ্রের সিপিএম সাংসদ রামচন্দ্র ডোম ২০১৩-১৪ অর্থ বর্ষের শেষ কিস্তির আড়াই কোটি টাকাই পাননি। ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষের জন্য বরাদ্দ ৫ কোটি টাকাও এখনও দূর অস্ত! রামচন্দ্রবাবু বললেন, “এ ভাবে চলতে থাকলে সাংসদ তহবিলের প্রাপ্য টাকা খরচ করা কোনও ভাবেই সম্ভব নয়!” দুই সাংসদেরই অভিযোগ, “প্রকল্প রূপায়ণের পরেও প্রয়োজনীয় ইউসি পাওয়া যাচ্ছে না। তার জন্যই এলাকার উন্নয়নের কাজ থমকে যাচ্ছে।” কিন্তু ইউসি পেতে সমস্যাটা কোথায়? সাংসদের কথায়, “উন্নয়নের কাজে টাকা বরাদ্দ করা হলেও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ (জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি, পঞ্চায়েত, সরকারি দফতর বা কোনও সংস্থা) কাজ শেষ করে ইউসি দিতে দেরি করছে বলেই সমস্যা তৈরি হয়েছে।” বোলপুরের সাংসদ সরাসরি দুষছেন প্রশাসনকেই। বীরভূম ও বর্ধমান জেলার প্রশাসনকে নিশানা করে রামচন্দ্রবাবু বলেন, “আমরা এলাকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের সুপারিশ করি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ কে হবেন, তার পরামর্শ দিই। তবে, বরাদ্দ এলে সেই সব কাজ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষকে দিয়ে করানো এবং ইউসি দেওয়ার দায়িত্ব স্বয়ং জেলাশাসকের। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক গড়িমসি ও সমন্বয়ের অভাব মিটিয়ে সাংসদদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করানোর ক্ষেত্রে প্রশাসনের ব্যর্থতাই প্রকট হয়েছে।”
নিয়ম অনুযায়ী, সাংসদ এলাকা উন্নয়নের জন্য (পানীয়জল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাস্তা, সেতুর মতো পরিকাঠামোগত উন্নয়ন, যা স্থায়ী হবে) বছরে ৫ কোটি টাকা সাংসদ তহবিল বাবদ পেয়ে থাকেন। নিজের লোকসভা কেন্দ্রের কোন এলাকায় কোন উন্নয়নমূলক কাজ হবে, পরিকল্পনা করা এবং কাজ কোন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ করবে, সে ব্যাপারে সাংসদ পরামর্শ দেবেন। তা বহু ক্ষেত্রেই গৃহীত হয় জেলা প্রশাসনের দ্বারা। তবে প্রকল্প রূপায়ণের কর্তৃপক্ষ (‘ইমপ্লিমেন্টারি অথরিটি) কে হবে, তা খতিয়ে দেখা, যোগ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া এবং কাজটি রূপায়ণের ক্ষেত্রে সমস্ত নিয়ম মানা হয়েছে কি না, সবই দেখতে হয় জেলাশাসককে। ফান্ড বরাদ্দ হলে রাজ্য ও সংশ্লিষ্ট জেলাশাসককে জানানো হয় এবং ‘ডিস্ট্রিক্ট প্ল্যানিং অফিসারে’র (ডিপিও)-র মাধ্যমে প্রকল্প রূপায়ণের দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হাতে টাকা পৌঁছে যায়। সাংসদ তহবিলের বরাদ্দ টাকা ঠিকমতো খরচ হচ্ছে কিনা, তা জেলা প্রশাসনের নোডাল দফতর দেখভাল করে। কাজ শেষে রিপোর্ট করার দায়িত্বও জেলা প্রশাসনেরই।
রামচন্দ্রবাবুর অভিযোগ নিয়ে প্রশাসনের কর্তাদের ব্যাখ্যা অবশ্য ভিন্ন। তাঁদের দাবি, রামচন্দ্র ডোমের লোকসভা আসনটিতে বীরভূমের চারটি বিধানসভা ছাড়াও বর্ধমানের কেতুগ্রাম, মঙ্গলকোট ও আউসগ্রাম এই তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রও পড়ে। বর্ধমানের ওই এলাকায় বরাদ্দ সাংসদ তহবিলের বহু কাজের ইউসি, প্রকল্প রূপায়ণের দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ না দেওয়ার ফলেই সমস্যা প্রকট হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা প্রশাসনের এক কর্তা আরও বলছেন, “জেলাপরিষদ, পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও সরকারি দফতর ছাড়াও রামচন্দ্রবাবু বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, ক্লাব বা অন্য কোনও সংস্থার হাতে বরাদ্দ রূপায়ণের দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে জেলা প্রশাসনের নিয়মিত যোগাযোগ নেই। এর ফলেই সমন্বয়ের অভাব ঘটছে। বহু ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত খরচও (এস্টিমেট) জমা পড়েনি।” বীরভূমের জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনার দাবি, “আমি শুধু ফান্ড ম্যানেজার। রামচন্দ্রবাবুর ক্ষেত্রে দু’টো জেলা হওয়ায় কিছু সমস্যা হয়েছে। খাতে বরাদ্দ এলে তা খরচ করতে কোনও সমস্যা নেই। শতাব্দী রায়ের টাকা এসেছে। তাঁর প্রস্তাবিত কাজও এগোচ্ছে।”
ক্ষুব্ধ রামচন্দ্রবাবু আবার বলছেন, “জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি, পঞ্চায়েত বা সরকারি দফতর প্রকল্প রূপায়ণের দায়িত্বে থাকলেই বরং ইউসি পেতে দেরি হয়। স্কুল, লাইব্রেরি বা ক্লাবে বরাদ্দ দিলে তুলনায় তাড়াতাড়ি ইউসি পাওয়া যায়। প্রশ্ন হচ্ছে ওই সব সংস্থার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনই বা কেন নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারেনি?” অন্য দিকে, বর্ধমানের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন বলেন, “ইউসি দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের জেলায় কোনও সমস্যা নেই। তবু কেন অভিযোগ উঠছে, তা খতিয়ে দেখব।”
কিন্তু, শতাব্দীর ক্ষেত্রে টাকা না পাওয়ার আশঙ্কা কেন তৈরি হয়েছে? জেলার ডিপিএও বিশ্বজিৎ মোদকের দাবি, “৫ কোটি টাকার কাজ চলছে। যত দ্রুত সম্ভব তা শেষ করে ইউসি জোগাড় করা হবে।” তবে জেলা প্রশাসনের একটি অংশই আবার ইউসি না পাওয়ার পেছনে অন্য একটি কথাও বলছেন। এ বার তৃণমূল সাংসদের যে ৫ কোটি টাকা এসেছে, তার একটি বড় অংশ বিভিন্ন তৃণমূল পরিচালিত পঞ্চায়েতগুলির জন্য অ্যাম্বুল্যান্স ও পানীয় জল বহনের ট্রেলার, ট্যাঙ্কের ক্ষেত্রে বরাদ্দ করা হয়েছে। শুধু দুবরাজপুর ও রাজনগর এলাকার ১২টি পঞ্চায়েতের ট্রেলার ট্যাঙ্কের এক একটির জন্য বরাদ্দ ৫ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা। তবে এ ক্ষেত্রে সাংসদ তহবিলের টাকা পাওয়ার কোনও নিয়ম মানা হয়নি বলেই মত প্রশাসনের একাংশের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই পঞ্চায়েতগুলির কোনও কোনও প্রধানও বলছেন, “টেন্ডার বা কোটেশন দেওয়ার যে পদ্ধতি আছে, তা না মেনে কলকাতার একটি নির্দিষ্ট সংস্থাকে ওই বরাত পাইয়ে দিয়ে সেই সংস্থাকে আগাম চেক দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে ইউসি দিতে সমস্যা তো হবেই!” দুবরাজপুরের ব্লক তৃণমূল সভাপতি ভোলানাথ মিত্র অবশ্য অভিযোগ মানেনি। পাশাপাশি তিনি বলেন, “সাংসদ দুবরাজপুর ব্লকের তিনটি সেতুর জন্য টাকা বরাদ্দ করেছেন। সেই কাজের টাকা পেতে ব্লকের সব পঞ্চায়েতের ইউসি যাতে দ্রুত পৌঁছয়, তা অবশ্যই দেখছি। আমাদের পাশাপাশি অন্য ব্লকগুলিকেও তা করতে হবে।”
অভিযোগ প্রসঙ্গে শতাব্দী রায় বলেন, “তেমন কিছু হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আমি শুধু চাই শেষ কিস্তির টাকা আসুক এবং উন্নয়নের কাজ যেন না আটকায়।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.