প্রবন্ধ ১...
পুরানো জানিয়া
দ্য শেষ হওয়া বছরটার কথা ভাবতে গিয়ে দেখছিলাম, প্রধানত মাথায় ঘোরাফেরা করছে গত বারো মাসে আমরা একসঙ্গে যে যে রাজনৈতিক-সামাজিক ঘটনাগুলোর মুখোমুখি হলাম, সে সবই। দিল্লির, থুড়ি, ভারতের সাহসিনী মেয়েটি চিরকাল আমাদের স্মৃতিতে থেকে যাবে। ২০১৩ সালটা আধুনিক ভারতের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে অন্য কারণেও: বছরের শেষ কয়েক সপ্তাহে আমরা মোহগ্রস্ত হয়ে দেখেছি আম আদমি পার্টির অসামান্য উত্থান। ‘আম আদমি’ জোয়ারের ফল ঠিক কী দাঁড়াবে, বলবে ভবিষ্যত্‌।
কিন্তু রাষ্ট্রের আওতা ছেড়ে আমরা যদি রোজকার জীবনে ফিরি, কী দেখব? এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার, ভারতীয় জীবনে সব কিছুর ওপরে সর্বদা রাষ্ট্রের ছায়াই বেশি ঘোরাফেরা করে। এই ছত্রছায়া ছেড়ে বেরোনোটা বাঙালিদের কাছে জরুরি, কেননা, অন্তত বাঙালিদের জন্য একটা অন্য ক্ষেত্রে ২০১৩ বছরটা উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে। বাংলার ক্ষেত্রে একটা অভিনব ধারার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। সেই বাংলায়, যেখানে রাজনৈতিক পরিবর্তনের বাইরে সামাজিক জীবনে নড়াচড়া বা পরিবর্তন ঘটে বড্ড কম। বলতে চাইছি বাংলা সিনেমার কথা, যেগুলো দেখার সৌভাগ্য হয়েছে ২০১৩ সালে। বাংলায় পর পর এমন অনেকগুলো ছবি পেয়েছি আমরা সম্প্রতি, যাতে একই সঙ্গে একটা ‘অন্য’ রকম ছোঁওয়া রয়েছে, আবার বাংলা সিনেমার একটা পুরনো যুগের কথাও এরা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এর একমাত্র তুলনা উনিশশো সত্তর দশকের গোড়ার সঙ্গেই সম্ভব। যদি ভাবি সত্তর-বাহাত্তর সালের সেই জমজমাট বাংলা ছবি-যুগের কথা একই সময়ে তৈরি অরণ্যের দিনরাত্রি, প্রতিদ্বন্দ্বী, সীমাবদ্ধ, সাগিনা মাহাতো, ইন্টারভিউ, কলকাতা ৭১, আবার পাশাপাশি উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া দেবী, মাধবী মুখোপাধ্যায় অভিনীত ছদ্মবেশী, নিশিপদ্ম, হার মানা হার, এখানে পিঞ্জর-এর মতো ছবি। চল্লিশ বছর পরেও নামগুলো একসঙ্গে দেখে অবাক না হয়ে উপায় নেই। আমার ধারণা, গত বছরটা অনেক যুগ পর আবার ফিরিয়ে এনেছে সেই উর্বরতা: ২০১৩ সব অর্থেই ‘অন্য’ ধারার বাংলার ছবির বছর। ‘নতুন’-এর বদলে ‘অন্য’ কথাটা ব্যবহার করলাম, কারণ ‘নতুন’-এর মধ্যে থাকে অতীতের সঙ্গে একটা বিচ্ছেদের ইঙ্গিত। এই বছরের অধিকাংশ ভাল ছবি কিন্তু অতীতের থেকে বিচ্ছেদ ঘটাতে চায় না, বরং তার সঙ্গে একটা ‘পুনর্ভ্রমণ’-এর সম্পর্ক তৈরি করতে চায়, সে কিউ-এর ‘তাসের দেশ’-ই হোক, কিংবা কমলেশ্বরের ‘চাঁদের পাহাড়’। অতীতকে আবার ফিরিয়ে আনছে এরা নতুনের মোড়কে।
আমার কাছে ২০১৩-র সেরা কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শব্দ’। ছবির নায়ক তারক ফলি আর্টিস্ট। সে ছবিতে ‘অ্যামবিয়েন্ট সাউন্ড’ তৈরি করত। এই শব্দ নিয়েই তার দুনিয়াটা এমনই ভরপুর ছিল, যে রোজকারের জীবনের ওপর থেকে তার নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ আলগা হতে থাকে। ‘শব্দ’ আমাকে একটা নতুন পথ দেখিয়েছিল। নৈঃশব্দ্যের মধ্যেও যে একটা শব্দ লুকিয়ে আছে, তাকে অনুভব করার কথা আরও এক বার মনে করিয়ে দিয়েছিল। আমায় ভীষণ ভাবিয়ে তুলেছিল, ‘টকি’-র মানেটা আসলে কী। এটা শুধুমাত্র গান আর নাচের মিউজিক তো নয়। বরং প্রতি দিনের শব্দ হর্নের প্যাঁ-পোঁ, বাসনের টুংটাং, সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ, চায়ের কাপটা আলতো করে নামিয়ে রাখার ঠুং শব্দটা। এই ছবিটাই আমাকে বাধ্য করেছিল স্থির হয়ে বসতে, চুপটি করে শুনতে, আর তার পর কলকাতার কলকলানির মধ্যে ফের ভেসে উঠতে, এই বোধ নিয়ে যে, ছোট ছোট কথা, আওয়াজে ভরা এই দুনিয়াতেও নিজেকে হারিয়ে ফেলা যায়।
এই দৈনন্দিন জীবনেরই আর একটা দিক দেখা গিয়েছিল কাঙাল মালসাট-এ। নবারুণ ভট্টাচার্যের লেখা ‘কাঙাল মালসাট’ উপন্যাস থেকে বানানো সুমন মুখোপাধ্যায়ের ছবি। সম্পূর্ণ অন্য স্বাদের। একটা কম-বাজেটের ছবিতে চোক্তার আর ফ্যাতাড়ুর দুনিয়াটাকে পর্দায় সৃষ্টি করে সুমন সম্ভবত দুটো কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। এক, সাধারণ মানুষের ক্ষমতার জোর। কোটি কোটি টাকা বাজেটের হাই স্পিড মোটরবাইক আর স্পেশাল এফেক্ট-মোড়া ‘ধুম থ্রি’ বা ‘কৃষ’-এর দরকার পড়ে না, বরং সুমনের সাদামাটা স্পেশাল এফেক্ট-এর মধ্য দিয়েই জোরালো ভাবে ফুটে ওঠে কলকাতা এবং বৃহত্তর ভারতের রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার মূলে থাকা এই সত্যটি, সাধারণ মানুষের এই অবিস্মরণীয় ভূমিকা। মনে করিয়ে দেয়, নয়াদিল্লির জাতীয় দলগুলোকে ঝাঁকুনি দেওয়ার জন্যও কোটি কোটি টাকার প্রয়োজন হয়নি, কাজে লেগেছিল কেবল এমন একটা দল যার দলীয় প্রতীক ঝাঁটা এবং এমন একটা নাম যা আমাদের জাতীয় পরিবারের বড়লোক জামাই ঠাট্টা করে এদের দিকে ছুড়ে দিয়েছিল। দুই, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের মতো সুমন মুখোপাধ্যায়ও রুপোলি পরদায় সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা নিয়ে অত্যন্ত সাহসী পরীক্ষানিরীক্ষা জারি রেখেছেন। কিছু কিছু শব্দে দর্শকরা শিউরে উঠেছেন। জানতে চেয়েছেন, বাঙালিরা কি এ ভাবেই কথা বলে? ‘বেঙ্গলি লিংগো’র মধ্যে এই সাধারণের উত্থান নিশ্চয়ই নতুন ব্যাপার নয়, তবে নিশ্চিত ভাবেই গ্রহণযোগ্য বা ভদ্র সীমার বাইরে এর অবস্থান। দৈনন্দিন জীবনযাপনে এই ভাষাকে টেনে আনার তাত্‌পর্য ভবিষ্যত্‌ই প্রমাণ করবে।
আরও দুটি অসাধারণ ছবির কথা না বললে ২০১৩-র বিশেষত্ব সম্পূর্ণ হয় না কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অপুর পাঁচালী’ আর কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ‘মেঘে ঢাকা তারা’। অদ্ভুত ব্যাপার, দুটো ছবিই বিষয়ের দিক থেকে জীবনীধর্মী, পুরনোকে নতুন করে খুঁজে বার করা, কিন্তু স্টাইলের দিক থেকে দুটো অসম্ভব রকমের আলাদা। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ প্রায় পুরোটাই সাদা-কালো, প্রকট নাটকীয়তা এর চলনে, ঠিক ছবির বিষয়ব্যক্তিত্ব চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের মতোই। উল্টো দিকে, ‘অপুর পাঁচালী’ আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় বাংলা সিনেমার অন্যতম সেরা মুহূর্ত ‘পথের পাঁচালী’তে, এবং এক অন্য ‘অপু’কে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়। বাংলার চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সেই সোনার দশকগুলোর স্মৃতি টেনে এনে এই দুটো ছবিই বাঙালিদের কাছে খুব জরুরি উপহার: এরা মনে করিয়ে দেয় যে, দুই প্রবাদপ্রতিম মানুষ সত্যজিত্‌ রায় আর ঋত্বিক ঘটকের সাহসী পরীক্ষানিরীক্ষা সে দিন আধুনিকতার ভিন্ন ভিন্ন পথ মেলে ধরেছিল আমাদের সামনে, বুঝিয়ে দিয়েছিল যে আধুনিকতার সুফলের সঙ্গে মূল্য হিসেবে ধরা থাকে তার কুফলগুলিও, তবু তার দিকে পিছন ফিরে থাকা সম্ভব নয়। আধুনিক মানুষ হয়ে উঠতে গেলে নিজেকে সমানে নতুন করে নির্মাণ করে যেতে হয়, অনবরত নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে হয়।
মনে হচ্ছে, ২০১৩ সালের বাংলা চলচ্চিত্র এই বার্তাটাকে যথেষ্ট পরিমাণে গ্রহণ করতে পেরেছে। সুলক্ষণ। দেখা যাক, ২০১৪ সালে এই নতুন আত্মনির্মাণের ধারা আমাদের কোথায় নিয়ে যায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.