দুষ্কৃতীর হাতে নিধন, প্রশাসনের দ্বারা দাহ সংস্কার! সব মিলিয়ে
মধ্যমগ্রাম কাণ্ড
নারী আন্দোলনের জন্য একটি তাজা সুখবর। লিখছেন
অনিতা অগ্নিহোত্রী |
পশ্চিমবঙ্গে এবং অন্যত্র কিছু বুদ্ধিজীবী আছেন, যাঁরা রাজ্যের কোথাও কোনও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেই প্রশাসনিক ব্যর্থতা, পুলিশি নিস্পৃহতা ইত্যাদি বলে ধিক্কার জানাতে থাকেন। এঁদের অসন্তুষ্ট স্বভাবের জন্যই মধ্যমগ্রাম ধর্ষণ ও হত্যার সাম্প্রতিক ঘটনাটিতে পশ্চিমবঙ্গের মেয়েদের অধিকার যে ভাবে ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষিত হয়েছে, তা কারও চোখে পড়ছে না। প্রশাসন ও পুলিশ এ যাবত্ রাজ্যে সাধারণত বিখ্যাত বিদ্বজ্জন, চিত্রতারকা বা ক্রীড়াবিদ এঁদের শ্মশানযাত্রা ও সত্কারের কাজে পারদর্শিতা দেখিয়ে এসেছে। এই প্রথম এক ট্যাক্সিচালকের কন্যার দেহসত্কারে পুলিশ এতটা মনোযোগ ও তত্পরতা দেখাল। তা-ও আবার এক বার নয়, দু-দু’বারের (ব্যর্থ) চেষ্টায়। শ্মশানের মতো জায়গায়, যেখানে মানুষ কেবল পোড়ার জন্যই কয়েক ঘণ্টা লাইনে শোয়, সেখানে ডেথ সার্টিফিকেট দাখিল করার মতো সেকেলে নিয়ম থাকার জন্যই পুলিশ পুরোপুরি সফল হতে পারল না।
এই ধর্ষণের ঘটনার পর চিরাচরিত নীতি অনুসরণ করেই পুলিশ প্রথমেই এফআইআর নেয়নি, এফআইআর দাখিল ও গ্রেফতারের পর আক্রান্ত মেয়েটিকে সুরক্ষা দেবার কোনও চেষ্টা করেনি, এবং মৃত্যুকালীন জবানবন্দির পরও অপেক্ষা করছিল ধৈর্য সহকারে, যাতে মেয়েটি সেরে উঠলেই অনুসন্ধান পর্ব আরম্ভ করা যায়। পুলিশের এই ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু মনোভাবের কোনও সদর্থক ব্যাখ্যা বুদ্ধিজীবীরা করছেন না, এটা খুবই আশ্চর্যের। প্রাথমিক পর্বে কিছুটা ধৈর্যশীল ও মন্থর হলেও, সত্কার পর্বে যে অসামান্য এবং অভূতপূর্ব তত্পরতা দেখানো হয়েছে তাতে মেয়েটির পরিবারের অন্তত কিছুটা কৃতজ্ঞতা দেখানো উচিত ছিল। |
শ্মশানে চ। নিমতলা, কলকাতা। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য। |
নারী আন্দোলনের পক্ষেও মধ্যমগ্রামের ঘটনা কিছুটা হলেও সদর্থক দ্যোতনা এনেছে। এ ক্ষেত্রে ধর্ষণের সময় মেয়েটি কী রকম পোশাক পরেছিল এবং ধর্ষকদের কোনও ভাবে উত্তেজিত করেছিল কি না, তার ফুটেজ না থাকায় তার পোশাক ও আচরণ কোনও ভাবে রাজনীতিক বা প্রশাসনের দ্বারা সমালোচিত হয়নি।
থানায় এফ আই আর করে ফেরার পরে মেয়েটি পুনর্বার ধর্ষিতা হয়। এ ক্ষেত্রে পার্ক স্ট্রিট বা কামদুনির মেয়েদের তুলনায় তার অপরাধ কার্যত দ্বিগুণ বলা যায়। বুদ্ধিজীবীরা আবার এটা নিয়েও অসন্তুষ্ট যে, মেয়েটিকে অন্তর্বর্তী সময়ে কোনও হোম বা সুরক্ষিত জায়গায় রাখা হল না কেন? এটাও অদ্ভুত দাবি! অনেক জ্ঞানী-গুণী মানুষই যেখানে অনেক বার ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, সত্যযুগ থেকেই ধর্ষণ হয়ে আসছে, এবং পুরুষের মধ্যেই ধর্ষক বাস করে, সে ক্ষেত্রে পুরুষের লিবিডো নিয়ন্ত্রণে না এলে বিকল্প ব্যবস্থা করা যায় কী ভাবে?
সে যা-ই হোক, মধ্যমগ্রাম কাণ্ডের আরও একটি উজ্জ্বল দিক হল, মেয়েটি সম্ভবত নিজে গায়ে আগুন লাগায়নি। এবং কোনও ভাবে একটি মৃত্যুকালীন জবানবন্দি দিতে পেরেছিল। তার প্রতি যাবতীয় প্রশাসনিক সহানুভূতি উবে যেত যদি সে আত্মহত্যার চেষ্টায় গায়ে আগুন দিত। না হয় দু-দু’বার ধর্ষণই হয়েছে, তার পর চলেছে লাগাতার লাঞ্ছনা ও উত্পাত। কিন্তু মানসিক দৌর্বল্যের কারণে আক্রান্ত মেয়েটি যে কোনও ভাবে প্রশাসন-পুলিশের প্রতি অনাস্থা দেখায়নি, বরং অপেক্ষা করেছে, যাতে যাবতীয় সাক্ষ্যপ্রমাণ বিলোপের চেষ্টায় দুষ্কৃতীরা তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয় এতে তার সহিষ্ণুতা এবং বিচক্ষণতাই প্রমাণিত হয়। সব মিলিয়ে মধ্যমগ্রাম কাণ্ড নারী আন্দোলনের জন্য একটি তাজা সুখবর।
পশ্চিমবঙ্গের মেয়েদেরও বলিহারি! মাথার চুল কপালে ঢেকে, বা না ঢেকেও, শাড়িতে, সালোয়ার কামিজে, বোরখায়, পরদাতেও তারা সর্বত্র বিরাজমান! বাসে ট্রামে, মাঠে-ময়দানে, গ্রামের রাস্তায়, নৌকোয়-মাঝনদীতে! যারা সর্বত্র সর্বদা দৃশ্যমান, কথাও বলে বেশ খোলাখুলি, রাখঢাক না করে, তাদের মাঝেমধ্যে একটু হুঁশিয়ারির অশনি সংকেত না দেখালে চলে কী করে?
মেয়েটির নাছোড় পিতা স্বরাজ্যে ফিরে যেতে রাজি না হওয়ায় তার পরিবারকে সর্বপ্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতির কথা শোনা যাচ্ছে। এ রাজ্যে আবার আক্রান্ত বা নিহত নারীর পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণের কোনও নির্ধারিত মানদণ্ড নেই। কোনও কোনও ক্ষেত্রে, যেমন কামদুনিতে, আন্দোলনের মাত্রা তীব্র হওয়ায় পরিবারের সদস্যদের তিন-তিনটি চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে জনগণের পকেটের উপর চাপ কমই যাবে, কারণ জনজাগরণ তেমন বিস্তৃত হয়নি।
পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন-মুখ্য বলেছেন, যেন মৃতদেহের উপর রাজনীতি না করা হয়। তাঁর উপদেশ শিরোধার্য। তবে জীবিতদের নিয়ে রাজনীতি খুব সীমিত ক্ষেত্রেই সম্ভব, যদি না অভিযুক্ত ব্যক্তি সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতির ওজনের বা অভিযোগকারিণী শিক্ষিতা, সমাজের পরিশীলিত বর্গের না হন। মধ্যমগ্রামের আক্রান্ত-নিহত মেয়েটি ও তার অভিযুক্তদের তেমন মাপ ও ওজন ছিল না। তবুও মধ্যমগ্রাম পশ্চিমবঙ্গের এ যাবত্ সমস্ত জীবিত নারীদেরই যে প্যাকেজ ডিল দিয়েছে তা এই আক্রার বাজারে মন্দ কী! দুষ্কৃতীর হাতে নিধন, প্রশাসনের দ্বারা দাহ সংস্কার! |