‘মার্স ওয়ান’ নামে একটি ওলন্দাজ সংস্থা ব্যবস্থা করিতেছে, ২০২৪ সালে চার জন মানুষকে তাহারা মঙ্গলগ্রহে পাঠাইবে। এই অভিযানে অংশ লইবার জন্য দরখাস্ত পড়িয়াছিল দুই লক্ষের অধিক, প্রায় এক সহস্র মানুষকে প্রাথমিক ভাবে বাছাই করা হইয়াছে, বাষট্টি জন ভারতীয়ও আছেন। পৃথিবী হইতে বহু মহাকাশ-অভিযানের পরিকল্পনা হয়, কিন্তু এই উড়ানটির ধর্ম স্বতন্ত্র: ইহা একমুখী। অর্থাত্, অভিযাত্রীগণ মঙ্গলে যাইবেন, কিন্তু আর ফিরত আসিবেন না। তাঁহারা মঙ্গলে মনুষ্য-বসতি স্থাপন করিবেন। দুই বত্সর অন্তর আরও চার জন করিয়া অভিযাত্রী প্রেরণ করা হইবে। এই মানুষেরা মঙ্গলেই থাকিবেন, টিভি দেখিবেন, বই পড়িবেন, হয়তো প্রজনন করিবেন এবং ওই গ্রহেই তাঁহাদের দেহান্ত ঘটিবে। ইহা নিশ্চিত জানিয়াই, বা বলা যায়, এই অভিজ্ঞতার লোভেই, এত জন মানুষ যাইবার আবেদন জানাইয়াছেন, মহাকাশচারী হইবার প্রশিক্ষণ লইতে উত্সাহী হইয়াছেন। মহাকাশে যাইবার ফ্যান্টাসি প্রায় সকল মানুষই লালন করে। কিন্তু ভিনগ্রহ-যাত্রা-কল্পনার অন্তে থাকে পৃথিবীতে ফিরিয়া নিজ অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি বিবৃত করিয়া, গৃহমধ্যে বসিয়া তাহার উত্তাপ অনুভব। অভিযান-কাহিনির শেষে নিরাপদে প্রত্যাবর্তন সেই অভিযানের সার্থকতার অভিজ্ঞান বহন করে। কিন্তু, কখনও ফিরিব না, আর কখনও এই পৃথিবীর ভূমি স্পর্শ করিব না জানিয়াই মহাকাশযানে উঠিয়া পড়া, ইহার জন্য প্রয়োজন এমন তীব্র দূরতৃষ্ণা, অচেনার প্রতি এমন উদগ্র মোহ, যাহা সকল পিছুটানকেই অস্বীকার করিবার ক্ষমতা রাখে। জন্মদাত্রী ও ধাত্রী বসুন্ধরাকে ত্যাগ করিয়া, তাহার মাধ্যাকর্ষণ ও অন্যান্য আকর্ষণ কাটাইয়া, নিজেকে চির-অনিশ্চিতের প্রতি নিক্ষেপ করিবার সিদ্ধান্ত খুব সরল সহজ নহে। অথচ এত সংখ্যক মানুষ নিজ অভ্যন্তরে সেই জ্বলন্ত আকাশাভিলাষ পুষিতেছিলেন, ১৪০টি দেশ হইতে তাঁহারা দলে দলে আবেদন করিয়াছেন!
সাধারণ মানুষ সমগ্র জীবন ধরিয়া কেবল নিজ অভ্যস্ত স্বচ্ছন্দভূমিটুকু রক্ষা করিতে সচেষ্ট হয়। একটি রাত্রি অন্য গৃহের শয্যায় কাটাইবার প্রস্তাবে তাহার হৃদয়ে অস্বস্তি ও বিরক্তির পলি পড়িতে থাকে। অফিস ও বাড়ির সংযোগকারী যাত্রাপথটি ছাড়িয়া সে একটি দিনের জন্যও অন্য সরণিতে ঢুকিয়া পড়ে না। তাহার ঔত্সুক্য জাগ্রত হয় কেবল কেচ্ছা ও দুর্ঘটনার ঘ্রাণ পাইলে। বিশাল অট্টালিকা পুড়িয়া যাইবার খবর পাইয়া সে সকল কাজ ফেলিয়া দগ্ধ মৃতদেহ দেখিতে লাইন দেয়। সেই সাধারণ মানুষের একটি অংশ যখন সত্যই বলিয়া উঠে পরিচিত হইতে অপরিচিতে লইয়া যাও, নিরাপদ থোড়-বড়ি হইতে বিপদের উত্সবে প্রেরণ করো, সেই প্রার্থনায় মানবজাতির অতুলন বৈশিষ্ট্যের স্বাক্ষর রহিয়া যায়। অবশ্যই দরখাস্তকারীদের একটি অংশ হুজুগের বশে অথবা নিতান্ত মজা দেখিতেই এই আহ্বানে সাড়া দিয়াছেন, অনেকে নিশ্চয় বিশ্বাসই করেন না এমন অভিযান আদৌ সম্ভব, তথাপি, যে কৌতূহল প্রতিবেশীর শয়নকক্ষে উঁকি দিবার উদ্দীপক, তাহারই একটি রূপ যখন অনেকের অন্তরে পরোয়াহীন সন্ধিত্সার জন্ম দেয়, মনে হয়, কেবল অঙ্গুলিমেয় কিছু আইকন নহেন, এই প্রজাতির বহু সদস্যই সম্ভ্রমের যোগ্য, কেবল তাহার মশারি ও ছত্রাক আবৃত অকুলীন যাপনের মধ্য হইতে জীবন-মুহূর্তগুলিকে পড়িতে জানিতে হইবে। মঙ্গলগ্রহে আদৌ সে পৌঁছাইতে পারিবে কি না, সেইখানে বসবাস আদৌ সম্ভব কি না, সেই গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ তাহার শরীরকে যথাযথ খাড়া হইতে দিবে কি না, প্রাথমিক উত্তেজনা অতিক্রান্ত হইলে পৃথিবীস্মৃতি তাহাকে অবসন্ন করিয়া ফেলিবে কি না, সকল প্রশ্নের উত্তরে সে যখন বলে, প্রতি মুহূর্তের এই বিলোপ-সম্ভাবনা ও সংশয়গুলিকে আস্বাদন করতেই তাহার যাত্রা, নিশ্চিতিকে বিসর্জন দিবার সংকল্পই তাহার কেতন, তখন মানুষের প্রতি বিশ্বাসের মানচিত্রটি কল্পবিজ্ঞান-গ্রন্থের প্রচ্ছদের ন্যায়ই ঝলমল করিয়া উঠে। |