সপ্তাহান্তে আত্মীয়েরা মিলে দল বেঁধে দিঘা বেড়াতে যাওয়ার অপেক্ষায় এক দিন আগেও মশগুল ছিলেন তাঁরা। শনিবার দুপুরে একবালপুরের তস্য গলিতে তাঁরাই ছবি হয়ে গিয়েছেন।
এলাকার তরতাজা তরুণ-তরুণীদের ফটো গলির দেওয়ালের ব্ল্যাকবোর্ডে সেঁটে দিয়েছেন মুহ্যমান আত্মীয়-বন্ধুরাই। গাড়িতে চেপে দিঘা যাওয়ার পথে এগরায় একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনায় এ দিন সকালেই পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ জানায়, মৃতেরা হলেন লিখত পরভিন ওরফে ডলি (২৪), ডলির দাদা মহম্মদ জুলফিকার আলি ওরফে আজহার (২১), বোন মুসারত পরভিন ওরফে জুলি (২১), ডলির খুড়তুতো বোন রওশনি রসন (১৮) এবং ডলির দেওর শেখ সোনু (২১)।
গাড়ির যে আরোহীরা বেঁচে গিয়েছেন, তাঁরাও মৃত্যুযন্ত্রণার শরিক। যেমন, ২৫ বছরের যুবক শেখ সানি। পেশায় ড্রাইভার, ওই যুবকই মালিকের গাড়িতে পরিবারের লোকেদের নিয়ে বেরিয়েছিলেন। গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসেও সানি কার্যত অক্ষত। কিন্তু স্ত্রী ডলি, ভাই সোনু-সহ আত্মীয়দের হারিয়ে তিনি যেন থম মেরে গিয়েছেন। |
এগরায় দুর্ঘটনাগ্রস্ত সেই গাড়ি। ছবি: কৌশিক মিশ্র। |
ঠিক কী ভাবে ঘটল দুর্ঘটনা?
এ দিন দুপুরে একবালপুরের নূর লেনে সানির মামার বাড়িতে গিয়ে তাঁকে এই প্রশ্ন করা হলে সানি যেন খানিকটা কেঁপে উঠলেন। নিজের বছর চারেকের কোলের মেয়েটাকে আর একটু কাছে টেনে শুধু দু’হাত জোড় করে প্রশ্ন থেকে রেহাই চাইলেন। সানির মেয়েও ছিল ওই গাড়িতে। প্রতিবেশীরা বলছিলেন, সকাল সাড়ে আটটায় দুর্ঘটনার পরে সানিই ফোন করে কলকাতায় অন্য আত্মীয়দের খবর দিয়েছিলেন। ক’জন আহতের সঙ্গে তাঁকেও কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু তারপর থেকেই সানি যেন থম মেরে গিয়েছেন। চোখের সামনে কাছের লোকেদের মৃত্যুর অভিঘাতে তিনি বিশেষ কিছুই বলতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন আত্মীয়েরা। শুধু নিজের মেয়েকে কিছুতেই কাছছাড়া করতে চাইছেন না। আত্মীয়েরাই ওই যুবককে আগলে রেখেছেন।
ঠিক কী ভাবে দুর্ঘটনা ঘটল, তা সানি গুছিয়ে বলতে না-পারলেও পুলিশ জানায়, এগরায় গ্যাংটাপুরের কাছে ঘটে দুর্ঘটনাটি। তখন সকাল সাড়ে আটটা। গাড়িতে ১২ জন যাত্রী ছিলেন। সানির হাত থেকে নিয়ন্ত্রণ ছুটে গাড়িটি একটি গাছে ধাক্কা মারে। সম্ভবত কুয়াশার জেরে সামনে কী আছে গাড়ির চালানোর সময়ে তা ঠাহর করতে পারেননি ওই তরুণ।
লিখত পরভিন ওরফে ডলি ও ডলির খুড়তুতো বোন রওশনি রসন (১৮) ঘটনাস্থলেই মারা যান। এগরা মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে মৃত্যু হয় আজহার ও জুলির। গুরুতর আহত অবস্থায় কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে মারা যান শেখ সোনু।
ঘটনাস্থলে গেলে স্থানীয় বাসিন্দা জয়দীপ দাস বলেন, “রাস্তার ধারে খুব জোর শব্দ শুনে আমরা ছুটে আসি। দেখি একটি গাড়ি গাছে ধাক্কা মেরেছে। গাড়িটির পিছনের দুটি চাকা গাড়ি থেকে আলাদা হয়ে রয়েছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার কাজে হাত লাগাই।” স্থানীয় সূত্রে খবর, দুর্ঘটনার পরে গাড়ির আরোহীদের মাধ্যমেই পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম (ববি)-কে খবর দেওয়া হয়। ববি তখনই ফোনে এগরার তৃণমূল নেতা জয়ন্ত সাউকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেন। জয়ন্তবাবু বলেন, “পুরমন্ত্রীর ফোন পেয়ে আমি গাড়িতে করে আহতদের কলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা করি।” খবর পেয়ে এগরায় গিয়েছিলেন, মৃত ও আহতদের জনৈক আত্মীয় সওকত আলি। তিনিই এসে মৃতদের দেহ শনাক্ত করেন। সওকত আলি বলেন, “সম্ভবত পথ ভুল করে ওরা এগরা-ভগবানপুর রাস্তায় ঢুকে পড়েছিল। তারপরই দুর্ঘটনা ঘটে।”
শুক্রবারই সানি ও সোনুর মা বিহারের জামালপুরে দেশে ফিরে যান। তারপরই পরিবারটির অনেকে মিলে গাড়িতে দিঘা রওনা দেয়। একবালপুরের নূর লেনে সানি-সোনুর মামাতো ভাই শেখ জাহিদ বলছিলেন, সানি গাড়ি চালাত আর সোনু সেলাই মেশিনের কাজ করত। পাড়ায় কারও বিপদে-আপদে সব সময়ে দু’ভাই পাশে দাঁড়াত। নতুন বছরের শুরুতেই এমন দুর্ঘটনায় গোটা পাড়াই শোকার্ত। |