শহর সাজাতে তাঁর উদ্যোগে ত্রিফলা বাতি বসিয়েছিল কলকাতা পুরসভা। বছর দেড়েকের মধ্যেই তার ১৫ শতাংশ অকেজো। কারণ মূলত চুরি। কোথাও বাতি নেই, কোথাও বা দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছে বাতিস্তম্ভ। চলার পথে প্রায়ই এমনটা নজরে পড়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এমন কিছু চোখে পড়লেই কখনও মেয়র, কখনও পুলিশ কমিশনার, কখনও বা পুরমন্ত্রীকে ফোন করে বিষয়টি জানান মুখ্যমন্ত্রী। কোথায় বাতি জ্বলছে না, তা দেখে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন তাঁদের। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁকে বলা হয়, চুরি আটকাতে না পেরে এই বিপত্তি ঘটছে। কিন্তু শহরের সৌন্দর্যায়নের ক্ষেত্রে কোনও আপস করতে নারাজ মুখ্যমন্ত্রী। তাই এ বার ত্রিফলা বাতিস্তম্ভের উপরে নজরদারি চালাতে ১০০ দিনের কাজের কর্মীদের নিয়োগ করতে পরামর্শ দিয়েছেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রীর কথামতো সে পথেই হাঁটছে পুরসভা। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “চুরি ঠেকাতে সজাগ করা হচ্ছে কাউন্সিলরদের। একশো দিনের কর্মীদেরও নজর রাখতে বলা হচ্ছে।” |
নিষ্প্রদীপ দু’টি ত্রিফলা। শনিবার, মধ্য কলকাতায়। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক। |
পুরসভা সূত্রের খবর, কলকাতায় প্রায় ১২ হাজার ত্রিফলা বাতিস্তম্ভ লাগানো হয়েছিল। খরচ হয় ২৭ কোটি টাকা। তার মধ্যে দু’হাজারেরও বেশি স্তম্ভ এখন বাতিহীন। কোনও স্তম্ভে ত্রিফলার তিনটি বাতির দু’টি খারাপ, কোনওটায় তিনটিই খারাপ। কোথাও আবার ঢাকনা ভেঙে উধাও বাতি! আলো দফতরের এক ইঞ্জিনিয়ারের কথায়, “গত এক বছরে ১৫ শতাংশ হয় খারাপ, নয়তো চুরি হয়ে গিয়েছে। পুলিশকেও জানানো হয়েছে। কিন্তু চুরি আটকানো যাচ্ছে না।” তিনি জানান, পুরসভার ১৪১টি ওয়ার্ডকে পাঁচটি এলাকায় ভাগ করা হয়েছে। ওই পাঁচটি এলাকা থেকেই পুলিশের কাছে চুরির অভিযোগ করা হয়েছে। এক পুরকর্তা জানান, পুলিশের কাছে গত দশ মাসে প্রায় শ’দুয়েক লিখিত অভিযোগ জানানো হয়েছে। সব অভিযোগ এক করলে শুধু চুরি যাওয়া ত্রিফলার সংখ্যাই সাতশোর কাছাকাছি।
এক পুলিশকর্তার বক্তব্য, “এমনিতেই পুলিশের অনেক কাজ। শহরের রাস্তায় কে কখন বাতি খুলে নিয়ে পালাচ্ছে, তা দেখা সহজ নয়। তা-ও কয়েকটি ক্ষেত্রে চোর ধরে দিয়েছি আমরা।” কাজটি যে সহজ নয়, তা মানেন মেয়রও। তাঁর কথায়, “শহরে মাদকাসক্তদের উপদ্রব বাড়ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারাই ত্রিফলার বাতি চুরি করে বেচে দিচ্ছে। কয়েক জনকে ধরাও হয়েছিল। কিন্তু সামগ্রি ফেরত পাওয়া যায়নি।” বিষয়টি নিয়ে কলকাতা পুলিশের সঙ্গে কথা বলা হবে বলে জানান তিনি।
চুরি ছাড়াও বেশ কয়েকটি রাস্তার স্তম্ভে আলো জ্বলছে না। মূলত ডায়মন্ড হারবার রোড, ভবানীপুর, ইলিয়ট রোড, হরিশ মুখার্জি রোড, শরৎ বসু রোড, ডি এল খান রোড, কাঁকুড়গাছি সিআইটি রোড এবং এপিসি রোডে ত্রিফলা বাতিস্তম্ভগুলির হাল ভাল নয় বলে জানান দায়িত্বপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ারেরা। যেমন জোন তিন-এর এক ইঞ্জিনিয়ার জানান, তাঁদের দায়িত্বে থাকা রাস্তায় অনেক গাড়ি চলাচল করায় কম্পনের মাত্রা বেশি। তাই কিছু কিছু বাতি ভেঙে যাচ্ছে। তাঁদের পর্যবেক্ষণ, ত্রিফলা বাতিস্তম্ভগুলির উচ্চতা কম থাকায় গাড়ির কম্পনে ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। কয়েকটি এলাকায় নতুন করে ত্রিফলা লাগানো হয়েছে। কিন্তু চুরি ঠেকানো না গেলে এতে লাভ কতটা হবে, তা নিয়ে সংশয়ে পুরকর্তারাই।
প্রসঙ্গত, ত্রিফলা আলো প্রথম থেকেই বিতর্কের কেন্দ্রে। দরপত্র ছাড়া বাজারদরের তুলনায় বেশি দামে ওই আলো কেনায় তৃণমূল বোর্ডের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। পুরসভার নিজস্ব অডিটেও অনিয়ম ধরা পড়ে। তার জেরে পুরসভার তৎকালীন ডিজি (আলো) গৌতম পট্টনায়ককে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ত্রিফলা বসানোর ক্ষেত্রে টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করে ‘কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল’ (সিএজি)। তাদের রিপোর্টে বলা হয়, বাজারদরের চেয়ে বেশি টাকা দিয়েও বাতিস্তম্ভ কেনা হয়েছে। বলা হয়, ত্রিফলার জন্য প্রায় আট কোটি টাকা বাড়তি খরচ করেছে পুরসভা। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হতে ওই বাতিস্তম্ভ লাগানো বন্ধ করতে বাধ্য হন পুর-কর্তৃপক্ষ।
নয়ছয় আর অনিয়মের পরে এ বার রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পুরকর্তারা জানান, আলো বসানোর সময়েই তা রক্ষণাবেক্ষণের দিকে নজর রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। অথচ পুরসভার তথ্যেই রক্ষণাবেক্ষণে খামতির তথ্য ধরা পড়েছে। |