বুথ হবে স্কুলে স্কুলে। সে জন্য আগুন জ্বালিয়ে, বোমা মেরে বাংলাদেশের ২০টি জেলার একশোরও বেশি স্কুল তছনছ করে দিল ভোট বর্জনের ডাক দেওয়া খালেদা জিয়ার দল বিএনপি ও তার শরিক জামাতে ইসলামির কর্মীরা।
রাত পোহালেই ভোট। বুধবার থেকেই লাগাতার অবরোধ চলছিল। তার মধ্যে শনিবার থেকে ৪৮ ঘণ্টার হরতালও ডেকেছে বিএনপি-জামাত জোট। শুক্রবার রাত থেকেই শুরু হয় স্কুলে স্কুলে হামলা। সঙ্গে পথচলতি যাানবাহনে পেট্রোল বোমা ছুড়ে আগুন লাগানো। এক দিকে কনকনে ঠান্ডা, তার মধ্যে এই আতঙ্কের পরিবেশ। ভোটের পরিচিত উৎসবমুখর ছবিটাই গিয়েছে হারিয়ে। এই পরিস্থিতিতে মানুষের আলোচনায় যদি ভোটের কথা ওঠেও, তা অন্য ভোটের কথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার জানিয়েছেন, বিরোধীরা এগিয়ে এলে মাস কয়েক পরে সকলকে নিয়ে ফের ভোট হতে পারে। আরও এক বার মানুষ নতুন সরকার বেছে নেবেন। কাল যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়েদুল কাদের ও আজ অর্থমন্ত্রী আবুল মুহিত মালও সেই ভোটের কথাই বলেছেন। মানুষেরও যেটুকু কৌতূহল, তা এখন সেই পরের ভোট নিয়েই। স্বাভাবিক। কারণ, এই ভোটে যে অশান্তি ঘুচবে না, বরং বিরোধী পক্ষের হরতাল-অবরোধ নতুন মাত্রা। জীবন-জীবিকা অতিষ্ঠ করে তুলবে, সবাই তা বোঝেন। |
অতন্দ্র প্রহরায়। শিলিগুড়ির কাছে ফুলবাড়ি সীমান্তে। শনিবার। ছবি:এএফপি |
বুঝছে শাসক দলও। একপেশে নির্বাচনে পেট্রোল বোমা, ককটেল হানার ঝুঁকি অগ্রাহ্য করে মানুষকে ভোটের লাইনে টেনে আনা কষ্টকর। আন্তর্জাতিক মহলে এই নির্বাচন ও সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেই গিয়েছে। ভোটের হার কম হলে সেই প্রশ্ন খোঁচা দেবে সাধারণ মানুষকেও। এ ভাবে সরকার গড়লেও তা পরিচালনা করা যে কম ঝক্কির হবে না, এখন থেকেই তা টের পাচ্ছে শেখ হাসিনার দল। দেড় মাসের হরতাল-অবরোধে ব্যবসা বাণিজ্য লাটে উঠেছে। দেশের মূল আয়ের সংস্থান হয় যে পোশাক রফতানি শিল্প থেকে, সেখানেও বরাত কমে তলানিতে ঠেকেছে। বিদেশি লগ্নিও মুখ ফেরাচ্ছে। তার ওপর বিরোধীদের হিংসাত্মক অসহযোগ চলতে থাকলে মানুষের যাবতীয় অসন্তোষ তখন সরকারের দিকেই ধাবিত হবে। সে ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা জারি করে বিরোধিতা দমনের বিকল্প হয়তো বাছতে হতে পারে হাসিনাকে। কিন্তু সে-ও স্বল্পমেয়াদি বিকল্প। আওয়ামি লিগের এক নেতার কথায় “জরুরি অবস্থা ইন্দিরা গাঁধীকেও সরকার থেকে উৎখাত করেছিল। সে অবস্থা কখনওই চাইবেন না হাসিনা।” বিষয়টি বুঝেছেন বলেই সব পক্ষকে নিয়ে অচিরেই আরও এক বার নির্বাচন করার কথা বলতে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীকে। অশান্তির হাত থেকে রেহাই পাওয়ার সেটাই যে দীর্ঘমেয়াদি পথ, মানুষও তা বোঝেন। আর সে জন্যই তাঁদের হা-হুতাশ সব পক্ষের অংশগ্রহণে কবে হবে সেই পরের নির্বাচন!
কিন্তু সব বুঝেও এই একপেশে নির্বাচনে কেন গেল আওয়ামি লিগ? প্রধানমন্ত্রীর যুক্তি গণতন্ত্র ও সংবিধানের শাসন সমুন্নত রাখতেই এই নির্বাচন করতে হচ্ছে। ২৪ জানুয়ারি সংসদ ও সরকারের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তার আগে নতুন সদস্যদের নির্বাচন করাটা বাধ্যবাধকতা। হাসিনার সাফ কথা, ২০০৬-এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারই সেনাদের সঙ্গে নিয়ে অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখল করেছিল। এ বার তাই কোনও ভাবেই কোনও অনির্বাচিত শক্তিকে ক্ষমতা ছাড়া হবে না। বিশ্বের সব গণতন্ত্রে সরকারকে রেখেই নির্বাচন হয়, বাংলাদেশেও হবে। কিন্তু সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় থেকেই নির্বাচন বর্জন করে হরতালের পথে হেঁটেছে বিএনপি-জামাত জোট। ‘সাজানো’ এই নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার আর্জি জানিয়ে শনিবার ইউটিউবে একটি বার্তা প্রকাশ করেছেন লন্ডনে স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকা বিএনপি নেতা ও খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান। নির্বাচন প্রতিরোধের ডাকও দিয়েছেন তারেক।
মন্ত্রীরা অবশ্য ভোটারদের ডাকছেন। প্রধানমন্ত্রীও সকলকে ভোট দেওয়ার আর্জি জানিয়েছেন। ৩০০ আসনের মধ্যে ভোট হচ্ছে ১৪৭টিতে। ১২টি দল ও নির্দল মিলিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৩৯০ জন প্রার্থী। প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানিয়েছেন, আগুন দেওয়া বুথগুলির বেশির ভাগকেই ফের গুছিয়ে নিয়ে ভোট নেওয়া হবে। ভোটারদের নিরাপত্তার সব ব্যবস্থাও হয়েছে। তবে হিংসার বিরাম নেই। শুক্রবার রাতে আওয়ামি লিগের বেশ কিছু অফিসও জ্বালিয়ে দিয়েছে দুষ্কৃতীরা। আজ সন্ধ্যায় রংপুর, নীলফামারি ও টাঙ্গাইলের কয়েকটি বুথে হামলা চালিয়ে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে জামাত কর্মীরা। গাইবান্ধায় ভোটকর্মীদের নৌকায় হানা দিয়ে ব্যালট বাক্স ও ভোটের কাগজপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু পুড়ে যাওয়া একশো স্কুল? শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের মতে, ভোটের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এই স্কুল পোড়ানো অভিযানের। একাত্তরে যে শক্তি স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, সেই মৌলবাদী শক্তিই এই কাজ করেছে। নাহিদ বলেন, “এ ভাবে নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করেই তারা স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চায়।” |