সীমান্তের দরজা খুললেই একছুটে কলেজমুখী মাহাবুবা
কালো, ভারী দরজাটা প্রথমবার খুলতে খুলতে প্রায় সকাল সাড়ে ৬টা। শেষ বার বন্ধ হয় বিকেল ৫টায়। ঘড়ির কাঁটা আর দরজাটার সঙ্গে জীবন জড়িয়ে গিয়েছে মাহাবুবার।
বছর উনিশের মাহাবুবা খাতুন দক্ষিণ দিনাজপুরের কুমারগঞ্জ থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার উজিয়ে পড়তে আসেন জেলা সদর বালুরঘাটের কলেজে। গ্রামের একমাত্র কলেজে পড়া মেয়ে। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ‘জিরো-পয়েন্ট’-এ অবস্থান বলে মাহাবুবার গ্রাম, সমজিয়া পঞ্চায়েতের উত্তরপাড়া ঘেরা রয়েছে কাঁটাতারে। ভারতীয় ভূখণ্ডের সঙ্গে গ্রামের যোগাযোগের পথের মাঝের কালো দরজাটা দিনে একাধিক বার নির্দিষ্ট সময়ে খোলে এবং বন্ধ হয়। কখন দরজা খুলবে, কখন বন্ধ হবেসেই নিরিখেই চলছে তরুণীর রাতদিন। তাঁর জীবন, পড়াশোনা।
সমজিয়াতে প্রাথমিক স্কুল, ডাঙারহাটে সিনিয়র মাদ্রাসা এবং কুমারগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়েছেন মাহাবুবা। গ্রামের বাড়ি থেকে কাছের কলেজ প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে পতিরামে। কিন্তু তরুণী বেছেছেন আরও দূরের বালুরঘাট মহাবিদ্যালয় (কো-এড)। কারণ, জেলা সদরে বইপত্র, নোট জোগাড়ের সুবিধে। এখন পড়েন কলাবিভাগের পাস কোর্সে।
বেলা ১০টায় কলেজ শুরু হলেও তরুণী বাড়ি থেকে বেরোন ভোরে। সাড়ে ৬টায় কাঁটাতারের দরজা খুললে প্রায় একছুটে সমজিয়া স্ট্যান্ডে। সেখান থেকে পৌনে ৭টায় সরাসরি বালুরঘাটের বাস পেলে ভাল। না হলে প্রায় আড়াই কিলোমিটার হেঁটে ফকিরগঞ্জে গিয়ে ট্রেকার-বাস মিলিয়ে দু’ঘণ্টার ধকল সয়ে কলেজে যান। ফেরার পথেও একই রকম ঝক্কি। বিকেল ৫টায় দরজা বন্ধ হওয়ার আগে পৌঁছতে না পারলে বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়। তাই আপাতত দুপুর ২টোর পরে কলেজে ক্লাস করার ঝুঁকি নেন না মাহাবুবা। কলেজে যান সোম, বুধ আর শুক্রবার। শুক্র আর রবিবার বরাদ্দ বালুরঘাটে শিক্ষকের কাছে পড়ার জন্য। পড়ে ফিরতে দেরি হলে বাড়ি ফেরার মায়া না করে থেকে যান আত্মীয়ের বাড়িতে। এই চেষ্টাটাকে “অসাধারণ” বলছেন সমজিয়া পঞ্চায়েতের তৃণমূলের প্রধান সুপর্ণা রায়। স্থানীয় বাসিন্দা তথা সমজিয়া পঞ্চায়েতের সিপিএম সদস্য রব্বানি সরকারের কথায়, “যে পরিস্থিতিতে থেকে মেয়েটা কলেজে পড়াশোনা চালাচ্ছে, সে জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।”
কেমন সে পরিস্থিতি?
সমজিয়া-উত্তরপাড়া গ্রামে কয়েকটা খুঁটি পড়েছিল, তবে বিদ্যুৎ আসেনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবং বিএসএফের অনুমতি না মেলায় কবে সেখানে বিদ্যুদয়ন হবে, তা বলতেও পারছেন না প্রশাসনের কর্তারা। কেরোসিন-লন্ঠনের আলোয় ইতিহাস, বাংলা, এডুকেশন, ঐচ্ছিক বাংলার নোট তৈরিতে অভ্যস্ত মাহাবুবাকে ঘিরে অবশ্য অন্য ‘আঁধার’ও আছে। তরুণী জানালেন, এলাকায় তাঁর সময়বয়সী বন্ধুদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে ১২-১৩ বছর বয়সে। কাঁটাতারে ঘেরা গ্রামের এই মেয়ের কান ‘‘কলেজে পড়ে কোন তির মারবি”, শুনতে শুনতে পচে গিয়েছে।
তা ছাড়া, যে ব্লকে এই কলেজ-ছাত্রীর বাস, সেই কুমারগঞ্জ আর্থ-সামাজিক ভাবেও জেলার মধ্যে খুব একটা এগিয়ে নেই। সাম্প্রতিক সফরে দক্ষিণ দিনাজপুরে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে দু’টি ব্লকে ১০০ দিন কাজের প্রকল্পের অবস্থা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেনকুমারগঞ্জ তার অন্যতম। প্রশাসন সূত্রের খবর, ব্লকে ১০০ দিনের প্রকল্পে এখনও পর্যন্ত কাজ মিলেছে গড়ে ২১ দিন। সরকারি মতে স্থানীয় অর্থনীতি প্রধানত কৃষিনির্ভর, বেসরকারি মতে, আয়ের একটা বড় উপায় চোরাচালান। সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) এবং প্রশাসনের দাবি, ১০০ দিনের প্রকল্পে দৈনিক মজুরি মেলে ১৫১ টাকা। আর ঝুঁকি নিয়ে গরু পাচার করতে পারলে সাধারণ ‘ক্যারিয়ার’দের আয় একরাতে প্রায় ৫০০ টাকা। ফলে, স্থানীয় বাসিন্দাদের একটা বড় অংশ জড়িয়ে গিয়েছেন পাচারে।
বিএসএফ সূত্রের খবর, প্রধানত গরু এবং দু’ধরনের কাশির ওষুধ (নিষিদ্ধ) চোরাচালান হয় আত্রেয়ী নদী ঘেঁষা সমজিয়া দিয়ে। অগস্টে এই এলাকাতেই দুই চোরাচালানকারী মারা গিয়েছে জওয়ানদের গুলিতে। দু’দেশের সীমানায় কাঁটাতারে ফাঁক আছে অনেক জায়গায়। মাহাবুবাদের উত্তরপাড়া ভারতের দিকে কাঁটাতারে ঘেরা। কিন্তু লাগোয়া বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার চিনির বন্দর থানার দিকে বেড়া নেই। নাম জানাতে না চাওয়া একাধিক স্থানীয় বাসিন্দার কথায়, “দরজা খোলা থাকলে আমরা ভারতের। বন্ধ থাকলে, বুঝে নিন।”
এই পারিপার্শ্বিকের মধ্যে মাহাবুবার পড়াশোনা চালানোটাকে “দারুণ ব্যাপার”, বলে মানছেন বালুরঘাট কলেজের অধ্যক্ষ তারাশঙ্কর বন্দ্যো। তাঁর আশ্বাস, উপস্থিতির সমস্যা হোক বা বইপত্র পাওয়ার অসুবিধাকলেজ থাকবে মাহাবুবার পাশে।
ঠিক যেমন মাহাবুবা পাশে পেয়েছেন পরিবারকে। বাবা আবদুল বাতেন মোল্লা গ্রামের মসজিদে ইমাম। সামান্য জমিতে চাষও আছে। চাষের কাজ করেন দাদা আবুল হাসান মোল্লা। নিজে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনা ছেড়ে দিলেও মা হাসনারা বিবি লেগে রয়েছেন মেয়ের পড়াশোনায় উৎসাহ দিতে। বোনের পড়াশোনা ঠিকঠাক হচ্ছে কি না, নজর রয়েছে আবুল হাসানেরও। বললেন, “মাহাবুবাকে বালুরঘাট কলেজের হস্টেলে রাখলে যাতায়াতের ধকলটা থাকত না। কিন্তু মা আর আমি ওর পড়াশোনা করতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না, সেটা নিজেদের নজরে রাখতে চেয়েছি। যাতে সঙ্গে সঙ্গে সমস্যা মেটাতে পারি। খেটে পড়াশোনা শিখছে। আশা রাখি, ভাল শিখবে।”
বন্ধুদের দৌলতে ‘মিস’ হয়ে যাওয়া কিছু ক্লাস-নোট জোগাড় করে আপাতত চালাচ্ছেন মাহাবুবা। তবে খুঁতখুঁতানি কাটছে না মেয়ের। বলছেন, “দরজা বন্ধ হয়ে যাবে ভয়ে ইতিহাসের অনেক ক্লাস মিস করতে বাধ্য হয়েছি। সুলতানি যুগের নোটটা এখনও জোগাড় হয়নি।”
প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এ ভাবে পড়াশোনা চালানো মেয়েটির ইচ্ছে ভবিষ্যতে শিক্ষিকা হওয়া। সম্ভব হলে গ্রামেরই স্কুলে, যেটা এখন নেই। তরুণীর কথায়, “গ্রাম থেকে অনেক বাচ্চা ৭-৮ কিলোমিটার দূরের স্কুলে পড়ছে। দরজা খোলা-বন্ধের উপরে ওদেরও পড়াশোনা নির্ভর করে। গ্রামে স্কুল হলে সে সমস্যা মিটবে।”
গ্রামে স্কুল আদৌ হবে কি না, সেটা অনেক দূরের ভাবনা। তবে দূরত্ব মাহাবুবার কাছে সমস্যা নয়। দরজা আর ঘড়ি সামলে শিক্ষার জন্য অনেকটা পথ পেরনো তাঁর অভ্যাস হয়ে গিয়েছে যে!





First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.