কখনও কাগজ কুড়োনোর নাম করে, আবার কখনও চা বা মিষ্টির দোকানের খরিদ্দার সেজে দুষ্কৃতী দলের এক সদস্য পৌঁছে যেত স্কুলের কাছাকাছি। তারপরে কোথায় সিঁড়ি, কোথাও কম্পিউটারের ঘর সব খুঁটিয়ে দেখে নিত। এমনকী সেই ঘরে কী ধরণের তালা লাগানো রয়েছে সে খবরও দুষ্কৃতীদের কাছে পৌঁছে যেত এদেরই মাধ্যমে। এভাবেই গত পাঁচ মাসে রাজ্যের পাঁচ জেলার অজস্র স্কুল থেকে দুষ্কৃতীরা কয়েকশো কম্পিউটার চুরি করে বলে পুলিশের দাবি। বৃহস্পতিবার দুপুরে ও রাতে নদিয়ার তাহেরপুর ও কৃষ্ণনগরে অভিযান চালিয়ে ওই দুষ্কৃতীদের পাঁচ জনকে গ্রেফতারও করে কালনা মহকুমা পুলিশ।
পুলিশ জানায়, ধৃতদের মধ্যে চার জন চোরাই কম্পিউটার বিক্রি করত। তাদের কাছ থেকে ২৪টি কম্পিউটার ও ২টি প্রজেক্টর ও ২টি প্রিন্টারও পাওয়া গিয়েছে। শুক্রবার তাদের আদালতে তোলা হলে চার দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেন বিচারক।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, উচ্চশিক্ষা দফতরের টাকায় রাজ্যের বেশিরভাগ উচ্চ বিদ্যালয়েই গত চার বছরে প্রচুর কম্পিউটার পৌঁছেছে। ছাত্রছাত্রীদের শেখানোর জন্য কোনও কোনও স্কুলে প্রজেক্টর ও প্রিন্টারও রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত বেসরকারি সংস্থার কর্মী আবার কিছু ক্ষেত্রে স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারাই ছাত্রছাত্রীদের কম্পিউটার শেখান। |
কালনা আদালত চত্বরে ধৃত পাঁচ। শুক্রবার তোলা নিজস্ব চিত্র। |
মাস পাঁচেক আগে থেকেই বর্ধমান, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগণায় এই দলটি সক্রিয় হয়। জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছ, তিরিশটিরও বেশি স্কুল থেকে কয়েকশো কম্পিউটার এই ক’মাসে চুরি গিয়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষের অভিযোগ অনুযায়ী, খোওয়া যাওয়া মালপত্রের হিসেব প্রায় ৫০ লক্ষ। অথচ একটার পর একটা অভিযান চালিয়েও এতদিন ওই দুষ্কৃতীদের নাগাল পায়নি পুলিশ। সম্প্রতি কালনা, মন্তেশ্বর, মেমারির বেশ কিছু স্কুলেও চুরির ঘটনা ঘটে। কালান মহকুমা থেকেই ৪১টি কম্পিউটার, একটি প্রজেক্টর ও প্রিন্টার চুরি যায়। তদন্তে নেমে মহকুমা পুলিশের একটি দল প্রথমে চুরি যাওয়া কম্পিউটারগুলি কোথায় বিক্রি হচ্ছে, কারা কিনছে সে সম্পর্কে খোঁজ শুরু করে। বিভিন্ন বাজারেও খোঁজ নেওয়া শুরু করে। বৃহস্পতিবার মহকুমা পুলিশের কাছে খবর পৌঁছয়, নদিয়ার তাহেরপুর এলাকার একাধিক দোকান ওই চোরাই কম্পিউটার কিনছে। শুরু হয় অভিযান। কালনার এসডিপিও ইন্দ্রজিৎ সরকারের নেতৃত্বে অভিযান চালান কালনা থানায় সিআই রাকেশ মিশ্র, ওসি দীপঙ্কর সরকার, মন্তেশ্বর থানার ওসি শেখ বখতিয়ার হোসেন-সহ কয়েকজন পুলিশ কর্মী। দুপুরে তাহেরপুর থেকে গ্রেফতার করা হয় প্রভাত রায়, হারাধন বিশ্বাস, রামকৃষ্ণ হাওলাদার ওরফে বাবু এবং প্রসূন হাওলাদার ওরফে জিকোকে। রাতে কৃষ্ণনগর থেকে গ্রেফতার করা হয় শুভঙ্কর কুণ্ডুকে। এদের কারও বাড়ির খাটের নীচ থেকে, কারও মোবাইলের দোকান, আবার কারও বাদ্যযন্ত্রের দোকান থেকে উদ্ধার করা হয় প্রচুর মালপত্র।
পুলিশ জানিয়েছে, তাহেরপুর থেকে ধৃত রামকৃষ্ণ শুধু চোরাই কম্পিউটার কিনতই না, চুরির সঙ্গেও সরাসরি যুক্ত ছিল। পুলিশের দাবি, তাহেরপুরের চার যুবক দুষ্কৃতীদের কাছ থেকে কম্পিউটারগুলি কিনে তারপরে কৃষ্ণনগরে শুভঙ্করের কাছে বিক্রি করত। হার্ডওয়ারে দক্ষ শুভঙ্কর মারফত চোরাই কম্পিউটার পৌঁছে যেত সাইবার ক্যাফে, কম্পিউটার স্কুল ও নানা প্রতিষ্ঠানে। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, নদিয়ার অনেক প্রতিষ্ঠান তো এখনও জানেই না তাদের কম্পিউটার চোরাই। ধৃতদের জেরা করে সে সমস্ত জায়গাতেও দ্রুত অভিযান চালানো হবে পুলিশ জানিয়েছে।
পুলিশ আরও জানায়, বেশিরভাগ স্কুলে রাত পাহারার ব্যবস্থা নেই। ফলে রাতের আঁধারে স্কুল লাগোয়া জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে কম্পিউটারের ঘরের তালা ভেঙে ঢুকত দুষ্কৃতীরা। সঙ্গে নিয়ে যেত ছোট ছোট প্লাস্টিকের বস্তা। তাতে কম্পিউটার ঢুকিয়ে বস্তার মুখ সেলাই করে দিত তারা, যাতে মাঝপথে পুলিশ তল্লাশি করলেও বস্তার উপর দিয়ে কিছু দেখতে না পায়।
এসডিপিও ইন্দ্রজিৎবাবু জানান, ধৃতদের জেরা করে আরও নানা তথ্য জানার চেষ্টা চলছে। তবে আশা করা যায়, স্কুল থেকে কম্পিউটার চুরি এ বার বন্ধ হয়ে যাবে। |