রাষ্ট্রপতি যাতে সুপ্রিম কোর্টকে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত করতে বলতে পারেন, সেই মর্মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রস্তাবে বৃহস্পতিবার অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। আর তার পরের দিনই জাতীয় আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনইউজেএস) অতিথি শিক্ষকের পদ থেকে ইস্তফা দিলেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়। ইস্তফাপত্রে তিনি লিখেছেন, ‘আমি স্বেচ্ছায় সরে যাচ্ছি। অতিথি শিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠানের উপরে আর বোঝা হয়ে থাকতে চাই না।’
তবে এই পদক্ষেপ যে বিভিন্ন দিক থেকে আসা চাপের মুখে মাথা নোয়ানো নয়, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় তা-ও জানিয়েছেন। এনইউজেএসের অতিথি শিক্ষক পদে ইস্তফা দিয়ে তিনি নিজের অবস্থান থেকে পিছু হটলেন কিনা, সে প্রশ্নের উত্তরে শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতির মন্তব্য, “পিছু হটার কোনও ব্যাপার নেই।” তা হলে পদ ছাড়লেন কেন?
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, “এনইউজেএসের কিছু অধ্যাপক বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন যে, আমি সেখানে থাকলে নাকি সেখানকার পরিবেশ ও তাঁদের মনোবল নষ্ট হবে। কী দরকার আর জোর করে থেকে!” তাঁর কথায়, “আমি ওখানে বিনা বেতনে পড়াতাম। নিজের খুশিতে পড়াতাম। আমার ছাত্রছাত্রীরাও আমার ক্লাস করতে খুব আগ্রহী ছিল। এখন যদি তাঁরা না চান, তা হলে আমার থাকার মানে হয় না।”
|
অশোকবাবুর বিরুদ্ধে যে মহিলা ইন্টার্নকে যৌন হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে, তিনি এনইউজেএসেরই ছাত্রী ছিলেন। অভিযোগকারিণী ঘটনার অব্যবহিত পরে আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক জন শিক্ষককেই সব কিছু জানান। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে যৌন হেনস্থায় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম গত নভেম্বরে সামনে আসার পরে, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে শিক্ষকদের একাংশ এনইউজেএস কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি করেন, অশোকবাবুর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়কে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।
আর তার পরেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাময়িক ভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করে এনইউজেএস। কথা ছিল, চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যকরী সমিতির বৈঠকে এ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। এনইউজেএসের উপাচার্য পি ঈশ্বর ভট্ট বৃহস্পতিবার জানিয়েছিলেন, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে চান। সোমবার সে বিষয়েই শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠকে বসার পরিকল্পনা। কিন্তু তার আগে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ই এনইউজেএসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। এনইউজেএস কর্তৃপক্ষ অবশ্য এ দিন জানিয়েছেন, সন্ধে পর্যন্ত তাঁরা অশোকবাবুর পদত্যাগপত্র হাতে পাননি। সূত্রের খবর, অশোকবাবু এ দিন রাতে দিল্লি গিয়েছেন। দু’-এক দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনি দেখা করতে পারেন বলেও খবর। তবে এ দিন রাত পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির সময় চেয়ে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের তরফে কোনও অনুরোধ আসেনি বলে রাষ্ট্রপতি ভবন সূত্রে জানানো হয়েছে।
এ দিকে পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে অপসারণের উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও রকম পদক্ষেপের বিরুদ্ধে এ দিনই সুপ্রিম কোর্টে মামলা রুজু করেছেন এক মহিলা। দিল্লির বাসিন্দা, এম পদ্মনারায়ণ সিংহ নামে ওই প্রবীণ নাগরিক পেশায় চিকিৎসক। শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি পি সদাশিবমের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে দাখিল করা আবেদনে তাঁর দাবি: বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের প্রতি তাঁর আবেদন, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ওই ইন্টার্নের পেশ করা অভিযোগটি বাতিল করা হোক। প্রসঙ্গত, ওই অভিযোগেরই প্রাথমিক তদন্ত সেরে সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের কমিটি জানিয়েছিল, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় সংশ্লিষ্ট মহিলা ইন্টার্নের সঙ্গে অবাঞ্ছিত আচরণই করেছেন।
এবং বিষয়টিকে ঘিরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা যে ভাবে একজোট হয়ে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের অপসারণের দাবি তুলেছেন, এম পদ্মনারায়ণের আবেদনে তারও সমালোচনা করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল ইন্দিরা জয়সিংহ বেআইনি ভাবে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করাতে আদাজল খেয়ে লেগেছেন বলে অভিযোগ তুলে তাঁকেও মামলার অন্যতম পক্ষ করা হয়েছে। আবেদনে মামলাকারী চিকিৎসকের যুক্তি, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগটি ২০১৩-র যৌন নিগ্রহ আইনের আওতায় পড়ছে না, কারণ ওই আইন অনুযায়ী ঘটনার তিন মাসের মধ্যে অভিযোগ জানাতে হবে।
আগামী সোমবার, ৬ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে মামলাটির শুনানি হবে। ইতিমধ্যে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের পাশে এ দিন দাঁড়িয়েছেন তাঁর প্রাক্তন সহকর্মী তথা সুপ্রিম কোর্টের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি আলতমাস কবীর, যাঁর মতে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদ না-ছাড়ার অধিকার বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বিলক্ষণ আছে। “মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদে ইস্তফা না-দেওয়ার অধিকার বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের আছে। এর বেশি আমি আর কিছু বলব না।” এ দিন মন্তব্য করেন বিচারপতি কবীর। তাঁর ব্যাখ্যা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পরে রাষ্ট্রপতির নির্দেশে সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টির তদন্ত করবে। আর সেই কারণেই এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু তাঁর পক্ষে বলা এখন সমীচীন নয়। তবে অভিযোগকারিণীর কি এফআইআর করা উচিত ছিল না?
এই প্রশ্নের জবাবে বিচারপতি কবীরের মন্তব্য, “সে কথাই তো সবাই বলছেন!”
পাশাপাশি লোকসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ তথা বর্ষীয়ান আইনজীবী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় এ দিনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। “আমার মতে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার পদক্ষেপ বেআইনি ও অবৈধ। এই ক্ষমতা শুধু রাষ্ট্রপতিরই আছে।” বলেন তিনি। সোমনাথবাবুর প্রশ্ন, “আমি আবারও বলছি, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠা মানেই তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়ে গেলেন, এটা হবে কেন? এটা কী হচ্ছে এ দেশে? কোনও যথাযথ অভিযোগ নেই, এফআইআর হয়নি, বিচার হল না, অথচ এক জন দোষী সাব্যস্ত হয়ে গেলেন? তা হলে তো নির্দোষ ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও সুযোগই থাকছে না!” লোকসভার প্রাক্তন স্পিকারের এ-ও পর্যবেক্ষণ, “অভিযোগকারিণীর নাম কেউ জানল না, অথচ অভিযুক্তের নাম সামনে চলে এল! গোটা ঘটনায় ষড়যন্ত্রের গন্ধই পাওয়া যাচ্ছে।” |