|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
বহু গ্রামের শিল্পশৈলী আজ শুধু খাতাকলমে |
দীপঙ্কর ঘোষ |
পটুয়াজ অ্যান্ড পটুয়া আর্ট ইন বেঙ্গল, ডেভিড ম্যাককাচ্চন/ সুহৃদকুমার ভৌমিক। ফার্মা কে এল এম, ১০,০০০.০০ |
কোনও কোনও বই সামনে এলে মেদুর কৃতজ্ঞতায় মন ভরে ওঠে। সেই অনুভবে বই শুধু অক্ষরের সমষ্টি থাকে না, অন্বেষকের বীক্ষা তাতে কালের পরশ রেখে যায়।
বঙ্গীয় লোকশিল্পে পটচিত্রের নিজস্ব জোরের জায়গা শুধু দৃশ্য মাধ্যমে নয়, তা শ্রাব্যও। এই সূত্রেই তৈরি হয় পটুয়া-পটিদার-চিত্রকর-পাটকারদের যাপনলিপি। এক বার কথায় কথায় বীরভূমের বাঁকু পটুয়াকে শিল্প-পরম্পরা নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তাঁর চটজলদি জবাব, ‘আমার বংশের কেউকে শিখাতে হবে না হাতেকলমে; ওই ফুল-ফলের মতো হয়ে যাবে।’ এই ধারাপথই পট-পটুয়ার অন্তঃস্থ বাণী। পটচিত্র, পটের গান আর ধর্মীয় দোলাচলের অবগুণ্ঠনের মাঝে পটুয়া সমাজ আজও আকর্ষণের ক্ষেত্র।
ডেভিড জন ম্যাককাচ্চন ও সুহৃদকুমার ভৌমিকের এই যৌথ প্রয়াসকে ‘নবরূপে সজ্জিত’ বলা যায়। পটচিত্রের মুদ্রিত রূপ তো বটেই সম্প্রতি তৈরি আদিবাসী পট, কালীঘাট পট আর আস্ত জড়ানো পটও এর কাঠামোয় সংযুক্ত। বিলেত থেকে ডেভিড বিশ্বভারতীতে ইংরেজি পড়াতে এসেছিলেন। পরে যোগ দেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে। ছাত্র হিসেবে সে সময়েই মেদিনীপুরের আমদাবাদ গ্রামের সুহৃদকুমারের সঙ্গে আলাপ। মূলত এই ছাত্রের সাহচর্যে, ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি শুরু তাঁর পট-পটুয়ার উদ্দীপ্ত খোঁজ। বাংলার মন্দিরের ভাস্কর্য দেখতে দেখতে গ্রাম-শিল্পীর তুলিকলাতেও মজে গেলেন তিনি। কিন্তু, মাত্র ৪২ বছর বয়সে ১৯৭২-এ প্রয়াত হন ডেভিড। তাঁর অনুপস্থিতিতে ছাত্রই সাঙ্গ করলেন বইটির রূপদান আর নবীকরণের কাজ।
|
স্বর্ণ চিত্রকর।
নয়া, পঃ মেদিনীপুর। |
বাংলার পটশিল্পের প্রাপ্তিস্থান ও শৈলীর বহিঃপ্রভাবের অনুপুঙ্খ পর্যালোচনা উঠে আসে ডেভিড ম্যাককাচ্চনের লেখায়। তবে শৈলীবিচারের সমস্যা আজ প্রকট। জড়ানো পটের গান যাঁরা করেন, সব পট সেই পটুয়াদের তৈরি নয়। বহু ক্ষেত্রে সংগ্রহশালাতেও পটের প্রকৃত শিল্পী, শিল্পগ্রাম আর সময়কালের সঠিক তথ্য থাকে অধরা। মুঘল-রাজপুত-ওড়িশি-ইউরোপীয় ধাঁচের মধ্যে লোকশিল্পের ধারা ঠিক কোন জোর নিয়ে টিকে থাকে, এ সন্ধানও কৌতূহল জাগায়। পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়া কেন বীরভূম, মুর্শিদাবাদ এমনকী অখণ্ড মেদিনীপুরের নানা কেন্দ্র থেকে বেশি পরিচিতি পেল, তারও সুলুকসন্ধান প্রয়োজন। মহিলা শিল্পীর কাজ, পটের দুর্গা অঙ্কনে সূত্রধর ছাড়া অন্যরাও শিল্পকাজে পারম্পর্য রাখছেন এ সবই সমকালীন চর্চার বিষয়। ডেভিড এমন বিশ্লেষণী গবেষণারই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। আবার, সুহৃদকুমার ভৌমিকের আলোচনা মুখ্যত পরিব্যাপ্ত পটচিত্রের সূচনাকালের সন্ধান। বৌদ্ধ জাতকের ‘চলন-চিত্র’, সাঁচির তোরণের পাথর খোদাইয়ের চলমান জগতের মাহাত্ম্য উল্লেখে আছে জড়ানো পটচিত্রের উত্সের খোঁজ। এখানে তিনি জড়ানো পটের দর্শনে চলমান ও চিরন্তন কালকেই ছুঁতে চেয়েছেন।
ডেভিডের সংগৃহীত পট যা বিলেতে রক্ষিত, তার কিছু আলোকচিত্র সহ এই বইতে মোট আলোকচিত্র ৮৮টি। রঙে, মানে, বিষয়ে বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য। বর্ণনা অংশে বানান বিভ্রাট এড়ানো যায়নি। জিল পারভিনের লেখা ভূমিকায় আগের সংস্করণের পৃষ্ঠা-উল্লেখে যে সূত্র-নির্দেশ ছিল, তার সঙ্গে এ বারে গরমিল। পরিভাষা-নির্ঘণ্টটি কাজের। সংকলিত কয়েকটি চিঠিতে আছে অন্বেষণপর্বে ডেভিডের আর্তি।
পরিক্রমণের পথ ধরে পটুয়াদের স্থানান্তরেরও দ্যোতনা ফুটে ওঠে। রঙিন পটের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে দারিদ্রলাঞ্ছিত শিল্পীজীবনের সাদাকালো বাস্তবতা। এই বইয়ের কোনও লেখাই তথ্য পরিসংখ্যানের ছক নয় আছে জীবন ও শিল্পের উদ্ভাস। রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য, সত্যপির, গাজিপট, সাহেব পট, ফরাসি বিপ্লব, সামাজিক পট ইত্যাদির কথা ও গানের নমুনা সংকলিত হয়েছে। পরবর্তীতে সংকলিত লেখায় দক্ষিণ কোরিয়ার কিম-কি-সুক ও নেদারল্যান্ডের ক্রিস্টিন কোয়েনিগ্স তাঁদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। আছে প্রভাতকুমার দাসের ১৯৭২-এ নেওয়া দুই শিল্পীর সাক্ষাত্কার। তবে শিল্পকলা গবেষণায় সুধাংশুকুমার রায়ের নিজস্বতা পট আলোচনাতেও ঔত্সুক্য জাগায়। তাঁর আক্ষেপ ছিল, বাংলার সংগ্রহশালায় উনিশ শতকের আগের পট নেই! সে সব চলে গেছে বিলেতের নানা সংগ্রহে। শিল্প-আঙ্গিকের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় পটুয়া বসতির নিজস্ব অঙ্কনরীতির প্রভেদ, সূক্ষ্ম তুলিটান, রঙ ব্যবহারের ভিন্নতা, পছন্দের কাহিনির বিষয় আছে তাঁর বিশ্লেষণী আলোচনায়। তমলুক-কালীঘাট-ত্রিবেণী শিল্প ঘরানা আর বীরভূম-কান্দি-কাটোয়া ঘরানা শুধু নয়, বহু গ্রামের শিল্প-ঘরানা আজ শুধু খাতায়-কলমে!
বাংলার জায়মান সংস্কৃতির আধারে পটশিল্পের ঘরানার সন্ধান মেলে প্রবীণ শিল্পীদের কথায়। এই সংযোগও হয়তো একদিন ছিন্ন হবে। হরেক হস্তশিল্প মেলায় বাণিজ্যের আদানপ্রদান ঘটছে গত দু-তিন দশক। শিল্পীদের সামনে ফরমায়েসি কাজের তাগাদা। প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়ে পারিবারিক ধারা বা আঞ্চলিক অঙ্কনরীতি, নকশা ফিকে হয়ে পড়েছে। গ্রামীণ এই শিল্পধারার ‘স্কুল’-এর চরিত্র আজ তাই বোঝা কঠিন। শুধুই চোখে পড়ে সময়ের সাথে মানিয়ে নেওয়া শিল্প ও শিল্পীর জগত্।
প্রায় পঞ্চাশ বছরের অন্তর্লেখ পটকথায় পাওয়া গেল প্রবহমান অনুভবী স্পর্শ। মহার্ঘ এই দশ-হাজারি প্যাকেজ-প্রকাশনা নিয়ে সাধারণ পাঠক হয়ত দোলাচলে থাকবেন। তবুও, বাংলার লোকশিল্পে পটুয়ার রূপটান আর গায়কির লোকায়ত মানচিত্রে এই বই এক স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত চিত্রপটলিপি।
|
|
|
|
|
|