মুখোমুখি...
প্রথম অঙ্ক

দাদা বলেছিলেন, তুই মরবি

কবীর সুমন
তারিখটা এখনও মনে আছে, মুহূর্তগুলোও। ৫ মে, ১৯৯১। শিশিরমঞ্চ। যাঁর বাড়িতে ভাড়া থাকতাম সেই জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়, পৃষ্ঠপোষক বারীন রায় ও আরও কিছু সহৃদয় বন্ধুবান্ধবের উদ্যোগে অনুষ্ঠান।
এসেছিলেন পূর্ব-পরিচিত গৌরকিশোর ঘোষ, পারিবারিক সূত্রে চেনা চন্দ্রোদয় ও মমতাশঙ্কর। মঞ্চে উঠে দেখি আগেই চেনা রবি ঘোষ তো এসেইছেন, সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
দেখে একটু যে ঘাবড়ে যাইনি তা নয়, তবে অনুষ্ঠান শেষে সৌমিত্রবাবুর সস্নেহ প্রশংসায় গদগদ হয়ে পড়েছিলাম। আমার এই একটা অনুষ্ঠানেই মা তাঁর আর্থ্রাইটিস সত্ত্বেও আসতে পেরেছিলেন।
তবে প্রথমে সে-অনুষ্ঠান নিয়ে আশঙ্কাও কম ছিল না। আমার দাদা আনন্দরূপ চট্টোপাধ্যায় শুধু আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে তর্ক করেই আগের দিন রাতে গড়িয়ায় তাঁর বাড়ি ফেরার শেষ বাসটা মিস করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘তুই মরবি টুটুল (আমার ডাকনাম), বাঙালি হারমোনিয়াম-তবলা ছেড়ে গিটার বাজানো গায়ক কিছুতেই নেবে না।’
ভয়ঙ্কর বকুনি খেয়েছিলাম জার্মানি-আমেরিকার পাকা চাকরি ছেড়ে গান গাইতে, গান বাঁধতে কলকাতায় ফিরে আসার জন্য। তবে সেই সাফল্যে দুঃখও মিশে আছে। এই অনুষ্ঠানের পরেই দ্রুত আমার নাম হয়ে গেল আর বিশেষ করে আমার ‘সুপার-স্টার’ সুলভ অতি-জনপ্রিয়তার কারণে আমার সংসারটা গেল ভেঙে। আমি-মারিয়া-ভার্জিনিয়া জীবনের সেই সুখী সময়টাকে আজও মিস করি। আজ আমি অনেকাংশে একা। তবে বিশ্বাস করি, শিল্পীদের একাই থাকতে হয়।

ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন
শান্তনু মৈত্র
সুরকার হিসেবে আমার প্রথম পেশাদার প্রকাশ তিনবার। যখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি একটা গানের দলে ছিলাম গিটারিস্ট হিসেবে। সেই আমিই যে একদিন নিজে গানে সুর দেব, আর সেই গান যে চিত্তরঞ্জন পার্কের পুজোর জলসায় গাওয়া হবে সেটা ছিল স্বপ্নাতীত।
এক বছর ধরে একটা গানে সুর দিয়েছিলাম। পুজো প্যান্ডেলে আড়াই-তিন হাজার লোক। অন্য বিখ্যাত সুরকারদের সুর দেওয়া কয়েকখানা গান গাওয়ার পর আমার দল আমার সুর দেওয়া গানটা গাইতে শুরু করল।
বুকের মধ্যে ভয়ঙ্কর দুরুদুরু। চেষ্টা করছি শ্রোতাদের মুখের অবস্থা লক্ষ করার। কিছুই যেন বুঝতে পারছিলাম না। গান যখন শেষ হল, শুরু হল শ্রোতাদের হাততালি। তখন মাইকে ঘোষণা করা হল সুরকার হিসেবে আমার নাম। লোকজন বলে উঠল, ‘গানটা শুনে মনে হচ্ছিল সলিল চৌধুরীর সুর!’ আমি যে তখন সলিল চৌধুরীর অন্ধ ভক্ত!
দ্বিতীয় বার পেশাদার সুরকার হিসেবে আমার প্রকাশ ঘটল একটা ভিডিয়ো অ্যালবামে। শোভা মুদগলের গাওয়া গানে।
প্রথম দিন ওঁকে ‘শিখো না নয়নো কি ভাষা’ গানটা শোনাবার সময় খুব ভয় করছিল। তার আগে কখনও অত বড় মাপের সেলিব্রিটির মুখোমুখি দাঁড়াইনি। গানটা শুনে উনি বললেন, ‘অসাধারণ কম্পোজিশন হয়েছে।’ ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন আমার।
তৃতীয় বার ‘পরিণীতা’ করার সময়। ফিল্মে সেই প্রথম। তার আগে প্রযোজক বিধু বিনোদ চোপড়া আমাকে বলেছিলেন, ‘ভাই দ্যাখো, এর আগে ‘নাইনটিন ফর্টি টু লাভ স্টোরি’-তে সুরকার ছিলেন আর ডি বর্মন। এর পর তুমি করছ। ভেবেচিন্তে সুর লাগিয়ো।’
প্রথম দিন যখন গান শোনাতে গেলাম, বিধুজি ‘রাত হমারি হ্যায়’ গানটা ছাড়া আর বাকি তিনটে একদম খারাপ হয়েছে বলে বাতিল করে দিলেন। খুব বিমর্ষ মনে বাড়ি ফিরেছিলাম। তার পর দিন গিয়ে ‘পিউ বোলে’ শোনালাম। বিনোদজি ভালমন্দ তেমন কিছু বললেন না। শুধু বললেন, “মনে হচ্ছে এই গানটা অনেক দূর যাবে। তুমি পঞ্চম নও। কিন্তু যেই হও আমার পক্ষে বেশ ভাল।” বাকিটা তো ইতিহাস।

সেঞ্চুরিটা পেয়েই বুঝেছিলাম, অনেক দিন খেলতে পারব

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়
আমি এখনও বলি, লর্ডসে প্রথম ডেবিউ টেস্টে যে মনোভাব নিয়ে আমি খেলতে নেমেছিলাম, সেটা আমার কেরিয়ারের সেরা।
লর্ডস টেস্টের পর আমি আরও একশো বারোটা টেস্ট খেলেছি। কিন্তু কখনও ওই ‘ফ্রেম অব মাইন্ড’টা পাইনি। লর্ডস টেস্টের পর যত বার নেমেছি তত বার আমার মনে কিছু না কিছু চলেছে। কখনও ফর্ম নিয়ে ভেবেছি। কখনও ব্যাট নিয়ে। কখনও পায়ের মুভমেন্ট নিয়ে। কিন্তু লর্ডস টেস্টের ওই ইনিংসটা স্রেফ বল দেখে খেলে দিয়েছিলাম! আমার তো মনে হয়, ওটাই ছিল আমার সবচেয়ে ভাল মাইন্ডসেট।
শুধু আমার কেন, যে কারও জীবনেই ওটা অসাধারণ মুহূর্ত হিসেবে থেকে যেত। প্রথম টেস্ট, ডেবিউ টেস্ট, সেখানে আবার সেঞ্চুরি। যে কোনও মাঠে সেটা একটা দুর্দান্ত ব্যাপার। ঠিক যে মুহূর্তে আমি লর্ডসে সেঞ্চুরিটা করেছিলাম, বুঝে গিয়েছিলাম যে এখন থেকে বহু দিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটটা খেলতে পারব।
অন্য একটা উদাহরণ দিই। ধরো কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন জিতে এসেছেন। স্বাভাবিক ভাবে জেতার পর তিনি বুঝে যাবেন যে এ বার আমার হাতে পাঁচ বছর সময় আছে। নিজের কাজটা আমি এ বার ঠিকঠাক করতে পারব। ফিলিংটা অনেকটা তেমন।

খুব ভয় পেয়েছিলাম

ভাইচুং ভুটিয়া
কুড়ি বছর আগের কথা। যেটুকু মনে পড়ছে, ম্যাচটার আগের রাতে দু’রকম অনুভুতি হচ্ছিল। এক দিকে যেমন ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলব বলে অসম্ভব উত্তেজনা ছিল, তেমনই আবার ভিতরে ভিতরে ভয় পাচ্ছিলাম, পারব তো? যত দূর মনে আছে তারিখটা ২ এপ্রিল ছিল। সম্ভবত শুক্রবার।
এয়ারলাইন্স গোল্ড কাপে বাংলাদেশের ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিংয়ের সঙ্গে আমাদের ম্যাচ দেখতে সে দিন যুবভারতীতে প্রায় চল্লিশ হাজার লোক। আর গ্যালারির সেই উপচে পড়া ভিড়ে আমার মনের যাবতীয় ভয়-ভাবনা-আশঙ্কা যেন উধাও হয়ে গেল। তখন শুধু একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে রিজার্ভ বেঞ্চে বসে সময় গুনছি, কখন নামব? মাঠে নামার সুযোগ পেলাম ৪৬ মিনিটে। দেবাশিস সরকারের বদলি মিডফিল্ডার হিসেবে নেমেছিলাম। ইস্টবেঙ্গল তখন ৪-৪-২ ছকে খেলত। ম্যাচটা আমরা জিতেছিলাম ৬-০ গোলে। সেদিন ৮৯ মিনিটে দলের শেষ আর কলকাতা ময়দানে নিজের প্রথম গোল করেছিলাম আমি।

রিনাদি বলেছিলেন, ‘তোমার ঠাকুমা কী সুন্দরী!’

ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত
‘শ্বেত পাথরের থালা’ ছবিতে আমার প্রথম অভিনয়ের দিনটাই মনে পড়ে। তার আগে টিভির জন্য একটা এপিসোডে অভিনয় করেছিলাম। সেই অভিনয় দেখেই প্রভাতদার (রায়) স্ত্রী প্রভাতদাকে আমার নামটা সাজেস্ট করেন এবং ‘শ্বেত পাথরের থালা’য় সুযোগ পাই।
এন টি ওয়ান স্টুডিয়োতে প্রথম দিনের শ্যুটিংয়ের কলটাইম ছিল সকাল আটটা। ভোর-ভোর পৌঁছে গিয়েছিলাম। একে প্রভাত রায়ের ছবি, তায় অপর্ণা সেন (রিনাদি), দীপঙ্কর দে-র (টিটোদা) মতো শিল্পীরা সেটে হাজির!
মা, ঠাকুমা দু’জনেই গিয়েছিলেন আমার সঙ্গে। ঠাকুমা আমার খুব ক্লোজ ছিলেন। রিনাদি ওঁকে দেখে বলেছিলেন, ‘কী সুন্দরী তোমার ঠাকুমা। উনি কি সব সময় তোমার সঙ্গে থাকেন?’ সে দিন রিনাদি আমার পড়াশোনা, অভিনয় করার ইচ্ছে এ সব নিয়ে অনেক প্রশ্ন করেছিলেন। আর প্রভাতদাকে বলেছিলেন, “মেয়েটা কিন্তু ভারী মিষ্টি!”
ভেতরে ভেতরে বেশ নার্ভাসই লাগছিল। তা ছাড়া অদ্ভুত কিছু অনুভূতি হয়েছিল।
সেই প্রথম ফেশিয়াল করা, ভুরু প্লাক করা, স্পেশাল হেয়ারস্টাইল! বার বার নিজেকে আয়নায় দেখছিলাম। তার আগে তো সাজগোজ বলতে ছিল বড় জোর একটু লিপস্টিক আর চোখে কাজল। আগে শুনেছি আর্টিস্টরা সেটে যান। সেই সেট প্রথম চোখে দেখলাম। একটা ডাইনিং টেবিলের সেট, যেখানে আমার সঙ্গে ভাস্কর (এই ছবিতে রিনাদির ছেলে) তার মায়ের আলাপ করিয়ে দিচ্ছে। ক্যামেরায় ছিলেন গিরীশ পাধিয়ার। মুখে আলো নিয়ে ‘অ্যাকশন’ বলার সঙ্গে সঙ্গে এক্সপ্রেশন দিয়ে ডায়লগ বলাতার আগেও নার্ভাস হয়েছিলাম। ভাস্করের তত দিনে দু’তিনটে ছবিতে কাজ করা হয়ে গিয়েছে। আমাকে খুব আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছিল। বলছিল, ‘নার্ভাস হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ এই দিনটার কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না। ‘শ্বেত পাথরের থালা’য় কাজ করেছিলাম বলেই তার পর বহু ছবির অফার এসেছিল।

অনুলিখন: সুমন দে, সংযুক্তা বসু, রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়,
প্রীতম সাহা, দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.