নির্বিচারে কাটা হয়েছে শাল, শ্রীহীন অরণ্য-শহর
বুজ হারাচ্ছে অরণ্যশহর ঝাড়গ্রাম। বিশেষ করে কমছে শালগাছা। বন দফতরের পরিসংখ্যানই বলছে, ১৯৮০ সালে শহরে শালগাছ ছিল প্রায় ২৫ হাজার। ২০০৬ সালে সংখ্যাটা কমে দাঁড়ায় ১০ হাজার। আর এখন তা ৪ হাজারে এসে ঠেকেছে।
অথচ ঝাড়গ্রামই রাজ্যের একমাত্র শহর, যা সংরক্ষিত ও সংগঠিত বনাঞ্চলের আওতায় পড়ে। একটা সময় শহরের প্রধান আকর্ষণই ছিল রাস্তার দু’ধারে সবুজ শালগাছের সারি। যত দূর দেখা যায় শুধুই সবুজ। পর্যটকদের আকর্ষণেরও অন্যতম কারণ ছিল এই শ্যামলিমা। ঝাড়গ্রাম পুরসভার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৮ সালে শহরে বনাঞ্চলের পরিমাণ ছিল ৮ বর্গ কিলোমিটার। ২০০৭ সালে পুরসভার সর্বশেষ সমীক্ষা বলছে, অরণ্যশহরে বনাঞ্চল মাত্র ৩ বর্গ কিলোমিটার। এর পরের বছরগুলিতে আরও নির্বিচারে বৃক্ষচ্ছেদ চলেছে।
২০০৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১০-য়ের ডিসেম্বর পর্যন্ত মাওবাদী-কমিটির আন্দোলনে শুধু ঝাড়গ্রাম পুর-এলাকায় শাল, সোনাঝুরি, মহুল, নিমের মতো ৫৯৮টি গাছ কাটা হয়েছিল। সরকারি এই পরিসংখ্যানের বাইরে আরও কয়েকশো গাছ কাটা পড়েছিল বলে অভিযোগ। তখন থেকেই শহরে গাছ কাটার দুষ্টচক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। গোড়ায় মোবিল, হিং, চুন দিয়ে অথবা লোহার গজাল পুঁতে বহু শালগাছ কৌশলে মেরে ফেলা হয়। শহরের বাড়বাড়ন্ত ও পরিকাঠামো তৈরির কারণেও মারা পড়েছে বহু গাছ। বন দফতর সূত্রে খবর, ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতাল সম্প্রসারণে ১০০টি শালগাছ কাটা হয়েছে। স্টেডিয়াম সম্প্রসারণে প্রথম দফায় ৭০টি শালগাছ কাটা হয়েছে। আরও ৭০টি গাছ কাটার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। দোকান, বাড়ি তৈরির জন্য অনেক গাছ কাটা পড়েছে। বহুতলেরও বলি হয়েছে বহু গাছ।
বিশিষ্ট পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বলেন, “লালগড় আন্দোলনের সময়ে প্রচুর সবুজ ধ্বংস হয়েছে। আমাদের হিসেবে গত ১০ বছরে ঝাড়গ্রাম শহর ও আশেপাশের এলাকায় প্রায় ১০ হাজার গাছ কাটা পড়েছে।”
ঝাড়গ্রাম স্টেডিয়াম সম্প্রসারণের আগে এখানেই ছিল শালের জঙ্গল। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
ব্যাপক হারে গাছ কাটার প্রভাব পড়ছে পর্যটনেও। মাওবাদী-পর্বে ঝাড়গ্রামে পর্যটকদের আনাগোনা কমেছিল। বছর দুয়েক হল সে সমস্যা মিটেছে। ফের পর্যটকের আনাগোনা শুরু হয়েছে। কিন্তু সবুজ হারানো ঝাড়গ্রাম তাদের হতাশ করছে। কলকাতার এক ভ্রমণ সংস্থার কর্ণধার রাজেশ গুপ্ত বলেন, “কয়েক বছর আগেও ঝাড়গ্রামে সড়ক ও রেলপথের দু’পাশে ঘন শালগাছের সারি ছিল। তা এখন অতীত। পর্যটকেরা ঝাড়গ্রামে গিয়ে কিছুটা হতাশই হচ্ছেন।”
রবীন্দ্রপার্ক, ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসের সামনে বৈকালিক পার্ক, মহকুমা পুলিশ অফিসারের আবাসন, ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতাল চত্বর, ঘোড়াধরা টাউনশিপ-সহ ঝাড়গ্রাম শহরের অধিকাংশ এলাকা থেকেই শালগাছ লোপাট হয়ে গিয়েছে। সব থেকে বেশি গাছ কমেছে পাঁচমাথা মোড় থেকে পুরনো ঝাড়গ্রাম শ্মশানকালী মোড় পর্যন্ত মূল রাস্তার দু’ধারে। প্রবীণ বাসিন্দা সাংবাদিক ও গবেষক তারাপদ কর বলেন, “১৯৫২ সাল থেকে ঝাড়গ্রামে রয়েছি। তখন এই শহর শালজঙ্গলে ঘেরা ছিল। আশির দশকের পর থেকে সুকৌশলে গাছ মারা শুরু হয়। ঝড়ে একটা গাছ ভাঙলে আরও ৪-৫টা গাছ কেটে পাচার করা হত। গাছ কেটে অবরোধ-আন্দোলনের পর এই প্রবণতা বাড়ে। এখন আবার গাছ কেটে বহুতল তৈরির হিড়িক শুরু হয়েছে।” শহরের আর এক প্রবীণ নাগরিক অবসরপ্রাপ্ত রেলকর্মী দেবব্রত চক্রবর্তীও মানছেন, “গত কয়েক বছরে শহরে শালগাছের সংখ্যা ভীষণ কমে গিয়েছে।”
নিয়ম অনুযায়ী, গাছ কাটা পড়লে সমহারে গাছ লাগাতেও হবে। কিন্তু ঝাড়গ্রামে তা হয়নি। বন দফতরের যুক্তি, পুর-এলাকার সর্বত্র বৃক্ষরোপণের দায়িত্ব তাদের নয়। শহরে যে দু’শো হেক্টর বনভূমি দফতরের অধীনে রয়েছে, সেখানে পর্যাপ্ত হারেই গাছ লাগানো হয়েছে। শহরের অন্যত্র গাছ লাগানোর দায় তাহলে কার? ঝাড়গ্রামের ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসার পার্থপ্রতিম ত্রিপাঠী বলেন, “ঝাড়গ্রামে বেশিরভাগ শালগাছই রয়েছে পূর্ত দফতরের এলাকায়। ওই দফতর বা পুরসভা চাইলে আমরা শাল-পিয়াশালের চারা দিতে পারি।” সবুজায়নে যে যথেষ্ট নজর দেওয়া হয়নি, তা মেনে নিয়েছে পূর্ত দফতর ও ঝাড়গ্রাম পুরসভা। পূর্ত দফতরের খড়্গপুর ডিভিসনের এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার তপন সাহা বলেন, “গাছ লাগানোর জন্য আমরা সে ভাবে কাউকে প্রস্তাব দিইনি।” আর প্রাক্তন পুরপ্রধান প্রদীপ সরকারের স্বীকারোক্তি, “শহরে এক হাজার শালগাছ লাগিয়েছিলাম। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রায় সবই মরে গিয়েছে। বেঁচেছে ৬টি গাছ।” ঝাড়গ্রামের পুরপ্রধান তৃণমূলের দুর্গেশ মল্লদেব নতুন করে গাছ লাগিয়ে অরণ্যশহরের শ্রী ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁর কথায়, “শহরের সৌন্দর্যায়নের সঙ্গে সবুজায়নেও বিশেষ গুরুত্ব দেব।” আশ্বাস কতটা বাস্তবায়িত হয়, সেটাই দেখার।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.