|
|
|
|
রাহুলের যোগ্যতা অসাধারণ, দল ঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নেবে
শঙ্খদীপ দাস • নয়াদিল্লি
৩ জানুয়ারি |
আর পাঁচ মাস।
তার পরে ব্যাটন হাতবদল করতে তৈরি তিনি।
শুক্রবার এই ভাবে নিজের বেরিয়ে যাওয়ার দরজাটা খুলে দিলেন মনমোহন সিংহ। একই সঙ্গে সহজ করে দিলেন রাহুল গাঁধীর প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার পথও।
শুক্রবার জাতীয় প্রেস সেন্টারে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী মণীশ তিওয়ারিকে পাশে নিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন মনমোহন, যাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কার্যত তাঁর শেষ সাংবাদিক বৈঠক বলেই মনে করছেন সকলে। কংগ্রেসের অনেক নেতাই বলছেন, এই সাংবাদিক বৈঠকের সুর আগেই বাঁধা হয়েছিল। চার বিধানসভা ভোটে হারের পর থেকে দলের অন্দরে যে প্রশ্নটা সব থেকে বেশি ঘুরপাক খাচ্ছিল, সেটা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে কবে সরছেন মনমোহন?
সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আজ অশীতিপর মনমোহন এই সংক্রান্ত কোনও প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা করেননি। নিজে থেকেই অবসরের রোডম্যাপ জানিয়ে দেন। বুঝিয়ে দেন, পাঁচ মাস পরই রেসকোর্স রোডের বাড়িটা ছাড়বেন তিনি। কিন্তু তার আগে ‘রিটায়ার্ড হার্ট’ (আহত হয়ে অবসর) হওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই। এর পিছনে দু’টি কারণ দেখালেন তিনি। এক, ইস্তফা দেওয়ার ভাবনা কখনওই তাঁর মনে আসেনি। আর দুই, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি অযোগ্য, এ কথা দলের কেউ তাঁকে বলেননি।
সওয়া এক ঘণ্টার সাংবাদিক বৈঠকের পরে মনমোহন কী বললেন, এই বিষয়ের থেকেও অনেক বেশি চর্চা হল ‘কেন বললেন’ নিয়ে। বাকি দিনটা তাঁর বিভিন্ন মন্তব্যকে কাটাছেঁড়া করেই কাটাল দিল্লির রাজনৈতিক অলিন্দ। এই সাংবাদিক বৈঠকের ফলে আখেরে কংগ্রেসের কতটা সুবিধা হল, উঠে এল সেই প্রসঙ্গও।
দলের একাধিক শীর্ষ নেতার মতে, চটজলদি বিশ্লেষণে দলের জন্য অন্তত দু’টি স্বস্তি দেখা যাচ্ছে। প্রথমত, মনমোহন প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন রাহুলের নাম সেই পদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করতে গেলে অনেক প্রশ্ন উঠত। তাতে মনমোহনের যেমন অমর্যাদা হতো, তেমনই ক্ষতি হতো কংগ্রেসেরও। এখন মনমোহন অবসর ঘোষণার পরে এই ঘোষণায় কোনও বাধা রইল না। দ্বিতীয়ত, এ দিন তিনি মূল্যবৃদ্ধি থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের ব্যর্থতার দায় যে ভাবে স্বীকার করে নিয়েছেন, তাতে রাহুলের সুবিধাই হল। কংগ্রেসের বড় অংশের মতে এর পরে লোকসভা ভোটের প্রচারে নেমে আর পুরনো সরকারের ব্যর্থতার দায় তাঁকে নিতে হবে না। বরং তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে এবং পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি নিয়ে ভোটে যেতে পারবেন। দলের একাধিক নেতার বক্তব্য, সনিয়া গাঁধীও এটাই চাইছিলেন।
এর পরে যে প্রশ্নটা পড়ে থাকে সেটা হল, প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে রাহুল গাঁধীর নাম কবে ঘোষণা করবে দল? কংগ্রেসের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার এক্তিয়ার প্রধানমন্ত্রীর নেই। তা দলই স্থির করবে। কিন্তু এটুকু জবাবে কি কংগ্রেস কর্মীদের মন ভরবে? মনমোহন তাই রাহুলের পথই প্রশস্ত করলেন না, তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করে বললেন, “প্রধানমন্ত্রীর পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য রাহুলের অসাধারণ যোগ্যতা রয়েছে। উনি মন্ত্রিসভায় যোগ দিলে সরকার সমৃদ্ধ হতে পারত। কিন্তু দলীয় দায়িত্বের কারণে রাহুল রাজি হননি। ওঁর এই নিষ্ঠাকে শ্রদ্ধা করি।” এটাই যে দলের নেতা-কর্মীদের মনের কথা, সেটা বোঝা গিয়েছে মনমোহনের সাংবাদিক বৈঠকের পরপরই। দলীয় তরফে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য জনার্দন দ্বিবেদী বলেন, “কংগ্রেসের সব নেতা-কর্মীই রাহুলকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে চাইছেন। কিন্তু সব কিছুরই একটা পন্থা রয়েছে। দল যথাসময়ে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবে।”
রাহুলের প্রসঙ্গ ছাড়াও নিজের দশ বছরের জমানা সম্পর্কে বেশ কিছু কথা বললেন মনমোহন। জবাব দিলেন একাধিক প্রশ্নের। সেখানে যেমন এল দেশ ও দলের সঙ্কটের মুহূর্তে তাঁর মৌনী থাকার বিষয়, তেমনই উঠল দুর্নীতি বা সরকারের ব্যর্থতার প্রসঙ্গ। সে ক্ষেত্রে বিষয় ধরে ধরে তিনি কোনও দায় নিজের ঘাড়ে রাখলেন, কোনওটার জন্য যুক্তি দিলেন, কোনওটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলেন। যেমন, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির দায় মেনে নিলেন। কিন্তু একই সঙ্গে যুক্তি দিলেন, এটা যেমন সত্যি, তেমনই এর ফলে কৃষকরা যে তাঁদের পণ্যের উপযুক্ত দাম পেয়েছেন, সে কথাটাও মিথ্যে নয়।
আবার দুর্নীতির প্রসঙ্গে অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর যুক্তি, “টুজি স্পেকট্রাম হোক বা কয়লা কেলেঙ্কারি, সবই ইউপিএ-র প্রথম মেয়াদে হয়েছে। সেটাই যদি মানুষের মূল অসন্তোষের কারণ হয়, তা হলে কংগ্রেসকে দ্বিতীয় বার সরকার গড়ার সুযোগ দিতেন না মানুষ।” একই সঙ্গে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে তাঁর মন্তব্য, “আমিই প্রথম স্বচ্ছতার সঙ্গে স্পেকট্রাম বণ্টনের কথা বলি। কয়লার ব্লক নিলামের মাধ্যমে বণ্টন করতে চেয়েছি।”
মনমোহন আজ এ-ও বোঝাতে চেয়েছেন যে, তাঁর সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে যে সমালোচনা হয়ে থাকে, তা-ও তিনি যথার্থ বলে মনে করেন না। তাঁর কথায়, “আমি সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আশা করি, বিরোধী পক্ষ ও সংবাদমাধ্যমের চেয়ে ইতিহাস আমার প্রতি একটু বেশি সদয় হবে।”
উঠেছে দেশ ও দলের সঙ্কটের মুহূর্তে তাঁর চুপ থাকার প্রসঙ্গও, জবাবে বলেছেন, “এই অভিযোগ ঠিক না। দলের মধ্যে প্রতিটা বিষয়ে কথা বলেছি। ভবিষ্যতেও বলব।” ও এসেছে ক্ষমতার দ্বৈত কেন্দ্রের বিষয়টিও। এ ক্ষেত্রেও ড্রিবল করে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় মনমোহনের বক্তব্য, “কংগ্রেস সভানেত্রী হিসেবে সনিয়া গাঁধী সব সময় সহযোগিতা ও সমন্বয় করে চলেছেন। কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তিনিও আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। এতে ভাল হয়েছে সরকারের।”
সাংবাদিক বৈঠকের অন্তিম পর্বে এসে মনমোহন জানিয়েছেন, হাতে মাত্র পাঁচ মাস সময় রয়েছে ঠিকই। তবে দেশকে বৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা শেষ দিন পর্যন্ত তিনি করে যাবেন। যদিও তাঁর এই প্রত্যয় দেখানো নিয়ে আর ভাবছে না কংগ্রেস। মাথার উপরে লোকসভা ভোটের খাঁড়া ঝুলছে। এখন মনমোহনের বিদায় ঘণ্টা বেজে যাওয়ার পরে দল রাহুল আবাহনে পুরোপুরি মন দিতে পারবে বলেই মনে করছেন নেতারা। তাঁরা চাইছেন, হাইকম্যান্ডও সেই কাজ শুরু করে দিক এ বার।
আর মনমোহন? তিনি কি লোকসভা ভোটের পর অবসর নেবেন? এ দিন এমন প্রশ্নের মুখেও পড়তে হয়েছিল তাঁকে। প্রশ্ন করা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী পদে মেয়াদ শেষের পর কি তিনি আত্মজীবনী লিখবেন? নাকি নাতি-নাতনিদের সঙ্গে খেলাধুলো করে অবসর কাটিয়ে দেবেন? জবাবে কিন্তু রাজনৈতিক সন্ন্যাস নেওয়ার কথা বলেননি মনমোহন। বরং সরাসরি উত্তর এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, “এ ব্যাপারে এখনও কিছু ভাবিনি। আগে সেই জায়গায় পৌঁছই, তার পর ঠিক করব।” তা হলে কি রাহুলের অধীনে দলের হয়ে কাজ করতে তিনি তৈরি? এর আগে এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আজকের মনমোহন এ ব্যাপারে স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই চুপ। |
|
|
|
|
|