|
|
|
|
নিভে যাওয়ার আগে যেন জ্বলে উঠলেন
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি
৩ জানুয়ারি |
মনমোহন সিংহ আত্মপক্ষ সমর্থনে আজ বললেন, “আমি আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবদের কোনও সুযোগ-সুবিধে পাইয়ে দিতে আমার দফতরকে কখনওই ব্যবহার করিনি।” ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে খুব সম্ভবত এটাই প্রধানমন্ত্রীর শেষ সাংবাদিক বৈঠক। বিদায়ী মনমোহন সেখানে অনেকটাই রক্ষণাত্মক। তবু যেন নিভে যাওয়ার আগে এক বার দপ করে জ্বলে ওঠা।
এই মনমোহন সরে যেতে প্রস্তুত, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ নির্বিবাদে মেনে নিতে রাজি নন। যিনি বিশ্বাস রাখেন, সমকাল যে ভাবে বিঁধছে, ভাবীকাল অন্তত এতটা নির্মম চোখে দেখবে না তাঁকে। এখনও প্রধানমন্ত্রীর পদে থেকে যাওয়া নিয়ে তাঁর যুক্তি, “জানি না আমার সম্পর্কে কে কী বলেছেন, কিন্তু কেউ তো ইস্তফা দিতে বলেনি।” আবার বিদায়ের প্রশ্নে শরণ খুঁজেছেন ভবিষ্যতের ইতিহাসে। এ দিন বারবার তিনি বলছিলেন, “ইতিহাস আমার কাজের বিচার করবে।” |
|
নানা মুহূর্ত, নানা মেজাজ। শুক্রবার সাংবাদিক বৈঠকে মনমোহন। ছবি: পিটিআই। |
ইউপিএ-র প্রথম পর্বের শুরুতে, ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞান ভবনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম সাংবাদিক বৈঠকে নিজের উপরে তখন কী প্রবল আস্থা মনমোহনের! যেন হঠাৎ হাতে পেয়েছেন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ! দ্বিতীয় ইউপিএ-র শুরুতে ২০১০ সালের ২৬ মে আরও একটি সাংবাদিক বৈঠক করেন তিনি। পরমাণু চুক্তির দু’বছর পরে। তখনও তিনি ‘সিং ইজ কিং’। সোশ্যাল মিডিয়ার কার্টুন জেমস বন্ড বা ফ্যান্টমের ছবিতে মনমোহনের মুখ কাট অ্যান্ড পেস্ট।
সেই দিনটি আর আজকের ইউপিএ-র দ্বিতীয় ইনিংসের তৃতীয় এবং সম্ভবত সর্বশেষ সাংবাদিক বৈঠক। আসমান-জমিন ফারাক। কয়েক রাজ্যের বিধানসভা ভোটে সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের পর কংগ্রেসেরই বহু নেতা মনমোহন হঠাও অভিযান শুরু করেছেন। এই অভিযানের নামকরণ হয়েছে, নীল পাগড়ি তাড়াও কর্মসূচি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অনেকে সে কথা বলছেন, ঘরোয়া আড্ডায়। ব্যথিত, ক্ষুব্ধ, বিরক্ত আজকের মনমোহন। তবু সর্দারজি মচকাবেন, কিন্তু ভাঙবেন না। দেড় ঘণ্টার বৈঠকে ১৬৫ জন সাংবাদিকের উপস্থিতিতে তিনি নানা প্রশ্নের জবাবে মাঝে মাঝেই চেষ্টা করেছেন জ্বলে ওঠার।
তাঁর হাসি দেখা যায় খুবই কম। তাঁর ‘মৌনতা’ নিয়ে প্রশ্ন হলে আজ কিন্তু হেসে ফেলেছেন মনমোহন। বেশ ‘রিল্যাক্সড’ ভঙ্গিতে আক্রমণ করেছেন নরেন্দ্র মোদীকে। যা বলেছেন তার মর্মার্থ, ঘাতক হওয়ার চেয়ে মৌনীবাবা হওয়া শ্রেয়। মৌনী মনমোহন আজও পরমাণু চুক্তির জন্য শ্লাঘা অনুভব করেছেন। বোঝাতে চেয়েছেন যে, তিনি রাহুল গাঁধীর মতো নবীন প্রজন্মের নেতাকে আসন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। কিন্তু সরকারের মেয়াদ শেষের মুখে তৈরি হওয়া যাবতীয় প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার মূল কারণ তিনিই, এমনটা মেনে নিতে রাজি নন মোটেই।
ইতিহাসে আশ্রয় খুঁজেছেন মনমোহন। ইতিহাস কিন্তু বলে আম-জনতার মন স্বতঃপরিবর্তনশীল। ইতিহাস তো সে কথাই বলে। ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গাঁধীকে বিরোধী নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী বলছেন, মা দুর্গা। ’৭১-এর বাংলাদেশ যুদ্ধের পর তাঁর ভাবমূর্তি তখন শীর্ষে। ১৯৭৫ সালে সেই ইন্দিরা আনছেন জরুরি অবস্থা। সিপিএম তাঁকে বলছে ডাইনি। আবার ১৯৮৪ সালের ‘মিঃ ক্লিন’ রাজীব গাঁধী ’৮৯-এ পৌঁছে ‘বফর্স গাঁধী’। বাজপেয়ী মাত্র ছ’বছরেই এই প্রতিষ্ঠানবিরোধী ঝড় টের পেয়েছেন। রাজ্যে-রাজ্যেও একই চিত্র। শীলা দীক্ষিত থেকে অতীতে চন্দ্রবাবু নায়ডু, কেউই প্রকৃতির এই আইন ভাঙতে পারেননি। জ্যোতি বসুকে বদলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ছবি দেখিয়ে এক নতুন সিপিএমের স্লোগান তুলে আরও পাঁচটি বছর ক্ষমতায় টিকতে পেরেছিল সিপিএম। একই ভাবে আজ কংগ্রেসের অনেকে চান, ১৭ জানুয়ারি মনমোহনকে সরিয়ে দিয়ে রাহুলকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করে নতুন কংগ্রেস গড়ার কথা বলুক দল।
সাফল্য-ব্যর্থতা তো পরের কথা। মনমোহন কিন্তু আজ বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি বিদায় নিতে প্রস্তুত, কিন্তু ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতে চান না। তিনিও বলেছেন, “সমকালীন সংবাদমাধ্যম বা বিরোধী দল যা-ই বলুক না কেন, ইতিহাস আমার প্রতি সদয় হবে।” |
|
|
|
|
|