|
|
|
|
সবল প্রধানমন্ত্রীর অর্থ যদি নরহত্যায় নেতৃত্ব দেওয়া হয়, তবে সেই দৃঢ়তার দরকার নেই |
মনমোহনের বেনজির আক্রমণ মোদীকে, পাল্টা মুখর বিজেপি
দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় • নয়াদিল্লি
৩ জানুয়ারি |
নিজের ভাণ্ডারের সবথেকে কড়া শব্দগুলোই যেন বেছে রেখেছিলেন নরেন্দ্র মোদীর জন্য। সাংবাদিক বৈঠকে বারেবারেই ছিটকে এল সেগুলো। কোনও রাখঢাক না করেই মনমোহন সিংহ বললেন, নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের সর্বনাশ হবে।
স্বাভাবিক যে, প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্য নিয়ে পথে নেমেছে বিজেপি। ‘আক্রান্ত’ মোদীকে বাঁচাতে দলের কর্মীরা তো বটেই, নেতারাও হইহই করে নেমে পড়েছেন আসরে। সাংবাদিক বৈঠকের প্রতিটি শব্দ আতস কাচের তলায় ফেলে মনমোহনকে বিদ্ধ করার কৌশল খুঁজছেন তাঁরা। মনমোহনের উদ্দেশে একাধিক কড়া মন্তব্য উড়ে আসছে গেরুয়া-শিবির থেকেও।
কিন্তু মৃদুভাষী প্রধানমন্ত্রী আজ যে ভাবে এবং ভঙ্গিতে মোদীকে তুলোধনা করেছেন, তার কাছে এ সব কিছুই বড় ফিকে লেগেছে! কী বলেছেন প্রধানমন্ত্রী?
এ দিনের সাংবাদিক বৈঠকে সওয়া ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে একের পর এক প্রশ্নের ঢেউ সামলেছেন সাবলীল ভাবে। দল, সরকার, সাফল্য-ব্যর্থতা সব কিছু নিয়েই বলেছেন অনেক কথা। একেবারে মনমোহনোচিত ঢঙে। কিন্তু বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদীর প্রসঙ্গ উঠলেই বদলে গিয়েছেন তিনি। |
|
সাংবাদিক বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। শুক্রবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই। |
চূড়ান্ত আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে একবার তিনি বলেন, “আমদাবাদের রাস্তায় নরহত্যায় নেতৃত্ব দেওয়াই যদি সবল প্রধানমন্ত্রীর অর্থ হয়, তা হলে সেই দৃঢ়তার প্রয়োজন নেই।” মোদী সম্পর্কে বলতে গিয়ে মনমোহন এ দিন একবার ‘ডিজাসট্রাস’ শব্দটিও ব্যবহার করলেন।
সংসদ অভিধান অনুযায়ী, ‘ডিজাসট্রাস’ শব্দের অর্থ সর্বনাশা। কোনও দুর্ঘটনা বা দুর্দশা ঘটায় এমন। কেমব্রিজ অভিধানের মতে, শব্দটির অর্থ অতিশয় খারাপ বা বিফল। আর অক্সফোর্ড অভিধান অনুযায়ী, খুব ক্ষতিকারক।
একবার নয়, দু’বারও নয়, আজ তিন-তিন বার বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছেন মনমোহন। সাংবাদিক বৈঠকে যখন তাঁর দুর্বল নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তখনও মনমোহন টেনে এনেছেন মোদীর প্রসঙ্গ। এমনকী সাংবাদিক বৈঠক শেষ করে ফিরে যাওয়ার সময়েও একটি প্রশ্নের জবাবে মনমোহন বলে ওঠেন, “মোদীর ইচ্ছা পূরণ হবে না!”
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কার্যত নিজের বিদায় ঘোষণার সাংবাদিক বৈঠক। সেখানে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অন্য একটি দলের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী সম্পর্কে তাঁর এই ধরনের শব্দ প্রয়োগ ঠিক না ভুল, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই বিতর্ক শুরু হয়েছে। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব মনে করছেন, মোদী সম্পর্কে মনমোহনের এই আক্রমণের পিছনে রয়েছে সুচিন্তিত কৌশল। এক, মনমোহন যতই ফের প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার কথা ঘোষণা করুন, তিনি নিজের প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পেতে চান। দুই, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের উত্থানের পর যে ভাবে লড়াইটা বিজেপি বনাম আম আদমি পার্টিতে পরিণত হচ্ছিল, সেখান থেকে মোড় ঘুরিয়ে কংগ্রেস বনাম বিজেপির লড়াইয়ের ক্ষেত্রটিও প্রস্তুত করলেন মনমোহন। আর তিন, সুশাসনের স্বপ্ন ফেরি করা মোদীর গায়ে দাঙ্গার তকমা এঁটে ফের মেরুকরণের রাজনীতিই উস্কে দিলেন মনমোহন।
এক সময় গুজরাতে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে সনিয়া গাঁধী ‘মওত কা সওদাগর’ অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন মোদীকে। তার পর থেকে মোদীকে এমন কড়া ভাষায় আক্রমণ করেননি কংগ্রেসের কোনও শীর্ষ নেতা। কারণ হিসেবে অনেকেই বলেন, সনিয়ার সেই মন্তব্যকে হাতিয়ার করে মোদী নিজেকে প্রায় শহিদের উচ্চতায় তুলে নিয়ে যান এবং গুজরাত ভোটে তার ফল ভুগতে হয় কংগ্রেসকে। তখন মোদী ছিলেন শুধু গুজরাতের নেতা। এখন তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী পদের দৌড়ে রয়েছেন। ফলে তাঁকে ঘিরে দলের অঙ্কও বদলেছে।
স্বাভাবিক ভাবেই এ দিন আসরে নামতে সময় নেয়নি বিজেপি। মনমোহনের সাংবাদিক বৈঠক শেষ হতেই সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংহ। মোদী সম্পর্কে মনমোহনের মন্তব্যকে ‘দুর্ভাগ্যজনক ও হাস্যকর’ বলে দলের কর্মীদের উদ্দেশে বার্তা পাঠান তিনি। যার জেরে দ্রুত দিল্লির নানা প্রান্তে বিজেপি কর্মীদের বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। বিজেপির লক্ষ্য, মনমোহনের মন্তব্যকে হাতিয়ার করে মোদীর পক্ষে হাওয়া টানা। ‘মোদী আক্রান্ত’, এই আওয়াজ তুলে মেরুকরণের সুবিধা ঘরে তুলতে এখন মরিয়া রাজনাথ-অরুণ জেটলিরা। ঠিক যে ভাবে উত্তরপ্রদেশে মুলায়ম সিংহের মেরুকরণের সুফল ঘরে তুলতে ব্যস্ত বিজেপি। দলের নেতাদের কৌশল, মোদী নিজে মেরুকরণের রাজনীতি করলে তা হিতে বিপরীত হতেই পারে। কিন্তু অন্য দল জমি তৈরি করে দিলে ফসল তুলতে বাধা কোথায়!
|
আশা করি, বিরোধী পক্ষ ও সংবাদমাধ্যমের চেয়ে ইতিহাস আমার প্রতি একটু বেশি সদয় হবে।
মনমোহন উবাচ |
ভোটে জিতলেই কি পাপ ধুয়ে যায়? আর মনমোহন যদি সেই যুক্তিতেই বিশ্বাসী হন, তা হলে তো নরেন্দ্র মোদী তিন-তিন বার গুজরাতে ভোটে জিতেছেন।
অরুণ জেটলি
|
|
একই সঙ্গে মোদীর প্রতি মনমোহনের আক্রমণকেও সামাল দিতে হচ্ছে বিজেপি নেতাদের। মনমোহনের বক্তব্য দিয়েই তাঁর মোদী-বিরোধী মন্তব্যের ধার কাটতে চাইছে দল। জেটলির মতে, “মনমোহনের যুক্তি, ইউপিএ-র প্রথম জমানার দুর্নীতির পরেও মানুষ তাঁদের ভোটে জিতিয়েছে। ভোটে জিতলেই কি পাপ ধুয়ে যায়? আর মনমোহন যদি সেই যুক্তিতেই বিশ্বাসী হন, তা হলে তো নরেন্দ্র মোদী তিন-তিন বার গুজরাতে ভোটে জিতেছেন।”
মনমোহন এ দিন কার্যত নিজের বিদায় ঘোষণা করে দেওয়ার পরে বিজেপির অন্দরে কিছুটা আশঙ্কাও উঁকি মারছে। দলীয় নেতৃত্বের মতে, তার অন্যতম কারণ, মনমোহন আজ শুধু নিজের বিদায় ঘোষণা করেননি। একই সঙ্গে রাহুল গাঁধীর জন্য ক্ষেত্রও প্রস্তুত করে রেখেছেন। রাহুল ইতিমধ্যেই মনমোহন-সরকারের কোনও দায় ঘাড়ে না নিয়ে নতুন করে দুর্নীতি মোকাবিলার কথা বলে নিজের এক পৃথক ভাবমূর্তি তৈরি করার চেষ্টা করছেন। আর মনমোহন এ দিন দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি-র মতো ব্যর্থতার দায় নিজের কাঁধে নেওয়ায় রাহুল অনেকটাই নিষ্কলঙ্ক রইলেন বলে মনে করছেন বিজেপিরই অনেকে। সেই হিসেবে মনমোহনের এ দিনের কৌশলে কিছুটা চাপে বিজেপি। ঘরোয়া স্তরে বিজেপি নেতারা তা কবুলও করছেন। তাঁদের বক্তব্য, কংগ্রেসের এই চালকে হারাতে পাল্টা নতুন কৌশল তৈরি করতে হবে। দলের কৌশল রচনায় বিজেপির অন্যতম মস্তিষ্ক অরুণ জেটলি বলেন, “যাবতীয় ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে মনমোহন সিংহ বিদায় ঘোষণা করেছেন। এ বারে কংগ্রেসের নতুন নেতৃত্বে যিনিই আসুন, তিনি ইউপিএ সরকারের ব্যর্থতা অস্বীকার করতে পারেন না। নির্বাচনে এই সরকারের খতিয়ান ও নেতৃত্বের বিচার হবে।”
এই প্রসঙ্গেই কংগ্রেসের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীকে নিশানা করে জেটলি বলেন, “গত দশ বছরে রাহুল গাঁধী সংসদে ও সংসদের বাইরে নেতা হিসেবে কতটা প্রভাব ফেলেছেন, তা অপরীক্ষিত নয়। সকলেই তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।” |
|
|
|
|
|