মধ্যমগ্রামের মেয়েটিকে যে ঠিক কত লাঞ্ছনার মধ্য দিয়া যাইতে হইয়াছিল, হয়তো কোনও দিনও তাহা যথার্থ ভাবে জানা যাইবে না। যেটুকু জানা যায়, তাহা মর্মান্তিক বলিলেও কম হয়। সন্দেহ নাই, ২০১২ সালের ডিসেম্বর হইতে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে একটি বড় পরিবর্তন ঘটিয়া গিয়াছে বলিয়াই এই মর্মান্তিক ঘটনা আজ এমন ভাবে সর্বজনগোচর হইতে পারিতেছে। প্রচারমাধ্যমের এই সদাজাগ্রত চক্ষুর মূল্য অপরিসীম, অন্যথা হয়তো এমন কাণ্ডও সমাজের অগোচরেই থাকিয়া যাইত। মুশকিল ইহাই যে, প্রচারমাধ্যমের দৃষ্টির সঙ্গে রাজনীতির দৃষ্টিও পাল্লা দিয়া তীক্ষ্নতর হইতেছে। নির্যাতিত নিহত মেয়েটির দেহ লইয়া যে অসহনীয় কুনাট্য ঘটিয়া গেল কলিকাতার বুকে, তাহা এই তীক্ষ্নায়িত রাজনীতিরই প্রমাণ। অবশ্যই, এমন ঘটনা নূতন নয়। অবশ্যই মৃতদেহ লইয়া এই নিকৃষ্ট দড়ি-টানাটানি বামফ্রন্ট আমলের রাজনৈতিক কুসংস্কৃতিরই উত্তরাধিকার, শাসক সি পি আই এম এবং বিরোধী তৃণমূল কংগ্রেস বারংবার এই বর্বর মানসিকতার চিহ্ন দিয়া গিয়াছে, অনতি-অতীত তাপসী মালিক এখনও রাজনীতি-স্মৃতি হইতে বিস্মৃত হন নাই। তবুও বলিতে হয়, গত বুধবার কলিকাতার হাসপাতাল রাজপথ শ্মশান জুড়িয়া যে প্রকট ঘৃণ্যতা দেখা গেল, একটি চূড়ান্ত অবমানিতা কন্যার মৃতদেহ লইয়া সিটু ও পুলিশের মধ্যে যে প্রকাশ্য খণ্ডযুদ্ধ বাধিল, প্রবল সন্তপ্ত পরিবারটির প্রতি যে নিষ্ঠুরতা দর্শিত হইল, তাহা এক কথায় অভূতপূর্ব। নূতন বত্সরের প্রথম দিনটিতে কলিকাতা নিজের রেকর্ড নিজেই ছাপাইয়া গিয়াছে, সাধু!
অথচ, করণীয়টুকু ছিল যথেষ্ট সহজ। মৃতদেহের মালিকানার যুদ্ধ ছাড়িয়া এই নারকীয় ঘটনা যাহারা ঘটাইয়াছে, তাহাদের খুঁজিয়া বাহির করিয়া দ্রুত গ্রেফতার ও বিচার। ঘটনার ফল লইয়া রাজনীতি না করিয়া ঘটনার কারণটিকে খুঁজিয়া বাহির করিবার কাজে রাজনীতির ক্ষমতা ব্যবহার। আর কত পথ হাঁটিলে তবে রাজনীতির এই অর্থটি আবিষ্কার করা সম্ভব হইবে, কলিকাতা কিংবা পশ্চিমবঙ্গ জানে না। যে রাজনীতিকে সহজেই ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যবহার করা সম্ভব হইত, অন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রাত্যহিক চর্চায় তাহাকে আর কত যুগ বন্দি করিয়া রাখা হইবে, জানা নাই। কোনও দলের দিকে আলাদা করিয়া তর্জনী উঠাইয়া লাভ নাই। রাজ্যের সরকার ও বিরোধী উভয় পক্ষের তীব্র অসংবেদনশীলতার সহিত পাল্লা দিতেছে ভিন্ রাজ্যের রাজনীতিও। উল্লিখিত পরিবারটি বিহার হইতে এই শহরে আসিয়াছে জানামাত্র বিহারের মুখ্যমন্ত্রী ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করিয়া বসিয়াছেন। যেন বিহার-আগত না হইলে ক্ষতির পরিমাণ কিছু পৃথক এবং সহনযোগ্য হইত। মানুষকে যোগ্য সম্মান না দিয়া যে কোনও ছলছুতায় সমানেই বিভাজনের রাজনীতি করিয়া নিজের সমর্থনভাণ্ডার পুষ্ট করিবার এই ভয়াবহ সহজিয়া ‘গণতন্ত্র’ কোনও রাজ্যের বা কোনও দলেরই একচেটিয়া নয়, প্রকৃতই সর্বভারতীয়।
একই রকম ভয়াবহ রাজনীতির বাহিরে যে বিস্তৃত সমাজ-পরিসর, তাহার নির্দয় আত্মকেন্দ্রিক সংকীর্ণতা। যে পাড়ার অধিবাসীরা একটি মেয়ের নির্যাতনের সংবাদে নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত ভাবে মেয়েটির উপরেই সরাসরি দোষারোপ করেন, এবং ‘এই সব ঘটনা’ ঘটাইবার অপরাধে তাহার পরিবারকে পাড়াছাড়া করিবার বন্দোবস্ত করেন, পরিচিত অপরাধীদের আড়াল করিবার চেষ্টা করেন, তাঁহাদের বিকৃত মানসিকতাই এই ব্যাপ্ত বিকৃত রাজনীতির ভরণ ও পোষণ করে। লক্ষণীয়, সাম্প্রতিক কালে নারী-নির্যাতন বিষয়ে যতই সচেতনতা বর্ধিত হউক, সামূহিক জীবনের এই পরিব্যাপ্ত সংকীর্ণতার ভার এখনও একই রকম জগদ্দল। সচেতনতা ও সংবেদনশীলতা দুইয়ের দূরত্ব যে বিস্তর, এবং ইহারা যে মোটেও এক সূত্রে গ্রথিত নহে, এ রাজ্যের রাজনীতি ও সমাজ, উভয়ই তাহা প্রমাণ করিয়া চলিতেছে। |